হলদিয়া থেকে এবিজি চলে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তিতে তড়িঘড়ি প্রলেপ লাগানোর কাজে নেমে পড়ল রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, রাজ্যের উদ্যোগে ডিসেম্বরের শেষ দিকে এ বারের ‘বেঙ্গল লিডস’ (বাণিজ্যমেলা)-এর আসর বসবে হলদিয়ায়। বাণিজ্যমেলার কেন্দ্রীয় চরিত্রও হবে সেই হলদিয়া। অর্থাৎ এই শিল্পাঞ্চলকে আরও বেশি করে বিনিয়োগকারীদের গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলাই মেলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে জানাচ্ছে মহাকরণ।
যদিও মাত্র দু’দিন আগে সেই মহাকরণে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “হলদিয়ায় কিছুই হয়নি।” তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এবিজি হলদিয়া ছাড়ার কথা ঘোষণা করায় সরকারের শিল্প-ভাবমূর্তি নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন ওঠে বণিকমহলে। সেই হলদিয়াতেই এ বার শিল্পমেলা আয়োজনের ঘোষণা করে ইতিবাচক বার্তা দিতে চাইছে সরকার। |
নতুন সরকার আসার পর গত বছর ডিসেম্বরে বেঙ্গল লিডস-এর আসর বসেছিল বাইপাসের ধারে, মিলনমেলা প্রাঙ্গনে। রাজ্যের শিল্পবন্ধু ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সেটাই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। মেলা উপলক্ষে রাজ্য সরকারের প্রায় সবক’টি দফতর স্টল দিয়েছিল। গোটা আয়োজনে খরচ হয়েছিল ২০ কোটি টাকার মতো। তার পর গত দশ মাসে জমি-জটিলতায় রাজ্যে বিনিয়োগের কাজ কার্যত থমকে থেকেছে। তার উপর এবিজি-ও রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিল্পমহল আরও আতঙ্কিত।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করে তাই বাণিজ্যমেলাকে কলকাতার বাইরেও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। শিল্পমন্ত্রীর কথায়, “হলদিয়া, শিলিগুড়ি, কল্যাণীর মতো রাজ্যের কয়েকটি জায়গা শিল্পের বড় কেন্দ্রস্থল। সেই বিবেচনাতেই এ বার বেঙ্গল লিডস হবে হলদিয়ায়।” বাণিজ্যমেলার প্রস্তুতিতে ৬ নভেম্বর হলদিয়া যাচ্ছেন পার্থবাবু। সঙ্গে থাকবেন সিআইআই-এর প্রতিনিধিরা। অ্যাসোচ্যাম-এর প্রতিনিধিকেও যেতে বলা হয়েছে। যৌথ ভাবে মেলার আয়োজন করবে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম এবং হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ (এইচডিএ)। পার্থবাবুর বক্তব্য, “হলদিয়ায় পেট্রোরসায়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, অটো হাব হতে পারে। এ ছাড়া অনুসারী শিল্প রয়েছে।” মারুতিকে হলদিয়ায় জায়গা দেওয়া হবে বলেও জানান শিল্পমন্ত্রী। সাম্প্রতিক জটিলতার জন্য এবিজি-র শ্রমিকরা যাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, ঘটনাচক্রে সেই শুভেন্দু অধিকারীই হয়েছেন বাণিজ্যমেলার প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান।
হলদিয়া শিল্পাঞ্চল দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে এইচডিএ। শুভেন্দুবাবু তার চেয়ারম্যান। মহাকরণের খবর, এবিজি-র ঘটনার অনেক আগে থেকেই হলদিয়ার শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই কয়েক মাস আগে এইচডিএ-কে ডিঙিয়ে শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই কমিটিতে শুভেন্দুবাবু ছাড়াও ছিলেন তৃণমূলের আরেক বিধায়ক শিউলি সাহা। টাস্ক ফোর্সের প্রথম বৈঠকে হাজির না হয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দুবাবু। সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি শিল্পমন্ত্রী। পরে টাস্ক ফোর্সের দ্বিতীয় বৈঠকে হাজির থাকেন তিনি। রাজ্যের এক মুখপাত্র জানান, শিল্পমন্ত্রীর হলদিয়া সফরের সরকারি উদ্দেশ্য বাণিজ্যমেলা হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি আসলে টাস্ক ফোর্সকে সচল করে তুলতেই হলদিয়া যাচ্ছেন।
|
চাপান-উতোর |
বিষয় |
এবিজি-র দাবি |
বন্দরের বক্তব্য |
জাহাজ আসা |
এত দিন যথেষ্ট জাহাজ আসেনি।
অথচ রবিবার থেকে দুই বার্থে নিয়মিত জাহাজ |
হাইকোর্টের নির্দেশ
মেনেই জাহাজ যাচ্ছে |
পণ্যের পরিমাণ |
বছরে ৯০ লক্ষ টন মাল খালাস করার কথা
বলেছিল বন্দর। ৫০ লক্ষের বেশি মেলেনি |
কত পণ্য দেওয়া হবে, তা
নিয়ে চুক্তিতে কিছু বলা নেই |
কর্মী ছাঁটাই |
কাজ নেই, এত কর্মী রেখে লোকসান |
ওরা কিছুই জানায়নি |
কেন চুক্তি খারিজ |
নিরাপত্তা নেই। বন্দরও সাহায্য করেনি |
সব ব্যবস্থা করেছি |
|
বাণিজ্যমেলা করলে হলদিয়ায় কতটা বিনিয়োগ আসবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু হুগলি নদীর এই শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ ঘিরে চাপানউতোর এ দিনও অব্যাহত। হলদিয়ায় শিল্প আসছে না বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তাকে আমল দিতে নারাজ শিল্পমন্ত্রী। তাঁর পাল্টা বক্তব্য, হলদিয়ায় শিল্পস্থাপনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক বারবার আপত্তি তুলছে কেন, প্রদীপ ভট্টাচার্য, অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সিরা বরং সেই প্রশ্নের উত্তর দিন। পার্থবাবু বলেন, “কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও নিষেধাজ্ঞা তুলছে না।” সহনমাত্রার বেশি দূষণ থাকার অভিযোগ এনে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে পরিবেশ-বান্ধব নয়, এমন শিল্পস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। পার্থবাবুর অভিযোগ, “গত ডিসেম্বর মাসে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও তা হয়নি।” শুভেন্দুবাবুরও অভিযোগ, “অধীর-দীপারা হলদিয়া নিয়ে এত চিৎকার করছেন। ওঁরা যদি রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে এতই চিন্তিত হন, তা হলে কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছেন না কেন?”
এইচডিএ সূত্রের খবর, পরিবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকায় হিন্দুস্থান কলস নামে একটি সংস্থা সেখানে বিটুমিন তৈরির কারখানা করার ছাড়পত্র পায়নি। আইপিসিএল নামে একটি বিদ্যুৎ সংস্থা পরিবেশের ছাড়পত্র না পেয়ে ব্যাঙ্কের ঋণ পাচ্ছে না। পরিবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কার্যত গত এক বছরে কোনও শিল্প সংস্থাই হলদিয়ায় বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়নি।
এবং এ সবের পরেও রয়েছে এবিজি-বিদায়ের টাটকা ক্ষত। বাণিজ্যমেলার কল্যাণে হলদিয়ার কপালে কতটা বিনিয়োগের শিকে ছেঁড়ে, সেটাই এখন দেখার। |