ইন্দ্রকুমার সিংহের চিঠিটি (‘শ্মশানে যাওয়ার ধরনধারণ’, আ বা প, ১৮-৯) আমার বেশ কিছু কালের বিক্ষুব্ধ, বিতৃষ্ণ মনটাকে নাড়া দিয়ে গেল। শবদাহ করতে যাওয়ার রীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে ভীষণ দৃষ্টিকটু তা একটু বিবেকবান মানুষ মাত্রের পক্ষেই অনস্বীকার্য।
আমার এই চিঠির অবতারণা শবদাহ-পরবর্তী নিয়ম ও ‘ভোজন উৎসব’-কে নিয়ে। অতি সম্প্রতি আমার ঠাকুমা গত হয়েছেন। আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। মৃত্যু-পরবর্তী অনুষ্ঠানের আড়ম্বর সম্বন্ধে তাঁর অত্যন্ত আপত্তি ছিল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিতের বিশাল তালিকা অনুযায়ী সব আয়োজন করা এও এক অবাস্তব ও মূল্যহীন নিয়ম বলেই তাঁর কাছে প্রতিভাত হত।
তার পর সমস্ত আত্মীয়স্বজন, শ্মশানযাত্রীদের উদর পূর্তি না-হলে মৃত আত্মা নাকি তৃপ্ত (?) হয় না। এই ভোজন-পর্ব সম্বন্ধে আমার কিছু সম্ভাব্য যুক্তি মনে হয়েছিল।
১) মৃত ব্যক্তির পরিবারবর্গের সঙ্গে সমবেদনা ভাগ করে নেওয়া।
২) মৃতের পরিবারের সাহায্যার্থে যে সবাই আছে, তা প্রমাণ করা।
৩) হতভাগ্য পরিবারকে দুঃখ থেকে সাময়িক সরিয়ে আনার জন্য আত্মীয়সমাগম।
কিন্তু আমার প্রথম যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয় আমারই দেখা একটি ঘটনা। শ্রাদ্ধের দিন দুপুরবেলা বাড়িভর্তি লোকজন। মামা ছাদের এক কোণে বসে দাদুর জন্য আকুল হয়ে কাঁদছে। সত্যিই কি আপনজনের দুঃখ পাঁচ জনের সঙ্গে ভাগ করা যায়! আর মৃতের পরিবারের সাহায্যের জন্য যে সবাই কী রকম আছে, তার প্রমাণ আর না-ই বা দিলাম। শেষ যুক্তির জন্য বলতে পারি শ্রাদ্ধের খাওয়াপর্ব শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় আত্মীয়দের বলতে শুনেছি, ‘ইলিশ মাছটা আরও টেস্টি হলে ভাল হত’, ‘পাবদার সাইজটা ভাল ছিল’, ‘মিষ্টিগুলো সাইজে বড় ছোট হয়ে গেছে’। সন্তানরা কতটা ভালবাসত তাদের বাবা/মাকে, এখন যেন তার বিচারও চলে খাওয়ার মান অনুযায়ী। মৃত্যু-পরবর্তী ‘ভোজন উৎসবের দিন’ এমন কিছু আত্মীয়কে দেখেছিলাম, যারা ঠাকুমা বেঁচে থাকতে কোনও দিন দেখাও করতে আসেনি। তারা কিন্তু এমন সাজপোশাক পরে সারাক্ষণই বেশ সহাস্য বদনে এসে খেয়ে গেল, যা দেখলে, তারা কোন অনুষ্ঠানে এসেছে বোঝা বড় কঠিন।
আমার দশ বছরের শিশুকন্যা আমার ঠাকুমাকে সবিশেষ ভালবাসত। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে প্রথমে সে খুবই কান্নাকাটি করেছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি তার দুঃখের সমস্ত অনুভূতি সে লিখেছে একখানা খাতায়। ভুলে ভরা বাংলা বানানে সে লেখা তার মনকে সাদা পাতায় উন্মুক্ত করেছিল। সব অনুষ্ঠান শেষ হতে বাড়ি যখন ফাঁকা, তখন আমার কন্যা (মৃত্যু বলতে ঠিক কী, এটাই তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা) একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘মা, কেউ মারা গেলেই কি এমন ভাবে আনন্দ করে খাওয়াদাওয়া হয়?’
তিলোত্তমা দাস। কলকাতা-৫৩
|
হলদিয়া বন্দর গত এক মাস ট্রেড ইউনিয়নের দাপাদাপি দেখল। (‘বন্দরের কাল’, সম্পাদকীয়, ৫-১০) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠনগুলি পরস্পরের বিরোধী। আর একই দলের বিভিন্ন গোষ্ঠী একে অপরের প্রতিস্পর্ধী। সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হয়, সকলেই ‘শ্রমিক স্বার্থ’ রক্ষা করছে। সেই স্বার্থরক্ষার দাপটে বন্দরের নাভিশ্বাস উঠেছে। কয়েকটি সংস্থা হলদিয়ায় আর ব্যবসা চায় না। আস্তে আস্তে হলদিয়া বন্দরে জাহাজ কমে যাবে। কিন্তু ‘শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন’ থামবে না। মুশকিল হল জাহাজ যদি না-আসে, তবে আর বন্দর থাকে কী ভাবে? বন্দর না-থাকলে কর্মরত শ্রমিকও আর থাকবে না। শ্রমিক না-থাকলে তাদের স্বার্থও নেই। |
ট্রেড ইউনিয়নের দোহাই দিয়ে বামেরা রাজ্য থেকে শিল্পকে জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে যে পেশির জোর দেখিয়েছিল, সেই পেশিই তাদের ৩৪ বছরের শাসনে শিল্পের অভাবে শিথিল হয়ে পড়ল। আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির হাতিয়ার। অথচ রাজ্যে বামফ্রন্টের আমলে অতিরিক্ত জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের জন্য ৫৬ হাজার ছোটবড় শিল্প ও বহু চা বাগান বন্ধ হয়ে গেল। আসল কথা, বিপ্লবের কাজে কৃষি ও শিল্পশ্রমিককে উদ্বুদ্ধ করা আর আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রশাসন চালানো এক নয়। সেটা চৌত্রিশ বছরের শাসনে অতীতের শাসক দল তথা বামফ্রন্ট বুঝে উঠতে পারেনি।
যে মারণ রোগ রাজ্যকে শেষ করছে, তা হলদিয়াতেও প্রাণান্তক হয়েছে। রোগটি আত্মঘাতী রাজনীতির। সুশাসনের জন্য পার্টির কবল থেকে প্রশাসনকে উদ্ধার করতে হবে।
সোমেশ্বর মল্লিক। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, চক-ইসলামপুর এস সি এম হাইস্কুল |