অবশেষে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন দিল্লির ‘উপহার’ প্রেক্ষাগৃহের মালিক সুশীল অনসাল। পনেরো বৎসর পূর্বে ওই প্রেক্ষাগৃহে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারাইয়াছিলেন ৫৯ জন ব্যক্তি। তাহার মধ্যে ছিল শিশুরাও। সম্প্রতি আদালতে তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত আবেদনের শুনানি চলিবার সময়ে সহসা জোড়হস্তে মৃতদের পরিবারের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন অনসাল। মৃতদের পরিবারবর্গ তাঁহাকে অবশ্য ক্ষমা করেন নাই। বরং আদালতে এই দীর্ঘ ন্যায়যুদ্ধে অভিযুক্তরা যে তাঁহাদের উপর বার বার চাপ সৃষ্টি করিয়াছে, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করিবার চেষ্টা করিয়াছে, অভিযোগকারীরা সেই কথাই মনে করাইয়া দিয়াছেন। বোধ হয় তাঁহাদের সন্দেহ, অনসালের এই ক্ষমা প্রার্থনা আন্তরিক নহে। জনসমক্ষে ক্ষমা চাহিবার ঘটনাগুলিতে এই সংশয় প্রায়ই ব্যক্ত হইয়া থাকে। বিশেষত রাজনৈতিক নেতারা যখন নিজেদের কৃতকর্মের জন্য, কিংবা পূর্বসূরিদের নানা অকীর্তির জন্য ক্ষমা চাহেন, অনেকেই সন্দেহ করেন যে কিছু সুবিধা কিংবা সমবেদনা পাইবার জন্য অনুতাপের অভিনয় করিতেছেন নেতারা।
কিন্তু অনেকে ইহার তাৎপর্যও খুঁজিয়া পান। বহু ক্ষেত্রে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমা চাহিবার কাজটি ঐতিহাসিক অন্যায়ের স্বীকৃতি রূপে বিবেচিত হয়। অন্যায় স্বীকার না করিলে তাহার প্রতিকার করিবার প্রথম শর্তটি পূরণ হয় না। সমাজে যখন কোনও একটি গোষ্ঠী অপরের উপর দীর্ঘ দিন ধরিয়া নির্যাতন করে, তাহাকে প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করে কিংবা তাহার অমর্যাদা করে, তখন তাহা প্রত্যহ ঘটিলেও ‘অপরাধ’ বলিয়া প্রতিভাত হয় না। কারণ তাহাই নিয়ম বলিয়া, এমনকী প্রার্থনীয় বলিয়া বোধ হইতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের যুগে যে কোনও দেশের আদিবাসীদের বন্য, বুদ্ধিহীন, নীতিবোধহীন বলিয়া দেখা হইত, তাই তাহাদের উপর নিপীড়ন অস্বাভাবিক বলিয়া কখনও বোধ হয় নাই। বরং তাহাদের শক্ত হাতে শাসন করাই প্রয়োজন বলিয়া মনে করা হইয়াছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই দাসপ্রথা সম্ভব হইয়াছিল। ব্রিটিশ জাহাজে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করিবার দুশো বৎসর পর যখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার দাস ব্যবসা ঘটিবার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করিলেন, তখন সেই দাস ব্যবসা আবারও ‘ঐতিহাসিক অন্যায়’ বলিয়া প্রতিভাত হইল। এ ভাবেই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ক্ষমা চাহিয়াছে, নাত্সি জার্মানিতে ইহুদিদের গণহত্যার সময়ে ক্যাথলিক চার্চ নীরব থাকিবার জন্য পোপ দ্বিতীয় জন পল ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন, অস্ট্রেলিয়ার সরকার ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছে বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসীদের নিকট। যাঁহারা এই সকল কুপ্রথার শিকার হইয়াছিলেন, তাঁহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গতায়ু। তৎসত্ত্বেও এই ক্ষমা প্রার্থনা অর্থহীন নহে। কারণ অপরাধ ঘটিয়া যাইবার পরেও তাহার স্মৃতি প্রজন্মে প্রজন্মে বাহিত হয়। নির্যাতনের বেদনাময় ক্ষতস্থান উত্তরপুরুষের জীবনদর্শন প্রভাবিত করে, তাহার ভালমন্দের বিচারকে নির্ণয় করে। তাই অতীতের ঘটনার জন্য অনুতাপ প্রকাশের প্রয়োজন রহিয়াছে, তাহা বর্তমান সংকটের সমাধানেরও ইঙ্গিত দেয়। যে কোনও গণহত্যা, গণনির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা জরুরি। সেই হিসাবে অনসাল আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ঠিকই করিয়াছেন। প্রার্থনা মঞ্জুর হইবে কি না, তাহা অন্য প্রশ্ন। |