পশ্চিমবঙ্গের ছয় জন মন্ত্রীর মাথার উপর ছয় জন উপদেষ্টা। এই ছয় জনই দলনেত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হইতে ইস্তফা দেন। সরকারি নির্দেশনামায় বলা হইয়াছে, তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসাবে কাজ করিবেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁহাদের সকলকেই রাজ্যের এক-একটি মন্ত্রকের সহিত জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, যেগুলি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে নাই এবং যেগুলির ভারপ্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন মন্ত্রীরা রহিয়াছেন। যেমন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র, শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিংবা নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। প্রশ্ন উঠিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি সরকার পরিচালনার প্রায় দেড় বছরের মাথায় উপলব্ধি করেন যে, কিছু মন্ত্রী প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করিতে ব্যর্থ, তবে তিনি তাঁহাদের বদলি করিতে পারিতেন। তাঁহাদের স্থলে নূতন কাহাকেও নিযুক্ত করাও মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ার। তাহা না করিয়া এই যে তিনি মন্ত্রীদের মাথার উপর একজন করিয়া উপদেষ্টা বসাইয়া দিতেছেন, ইহাতে কি প্রশাসন ও রাজ্যবাসীর কাছে ভুল সঙ্কেত যাইবে না?
প্রথমত, উপদেষ্টা পদে পদত্যাগী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিয়োগ বর্তমান মন্ত্রীদের কেবল চরম অস্বস্তিতেই ফেলিবে না (ঘাড়ের উপর ওজনদার এবং দলনেত্রীর বিশ্বস্ত অনুগতেরা নিঃশ্বাস ফেলিলে কাহারই বা স্বস্তি হয়), প্রশাসনের কাছে তাঁহাদের কর্তৃত্বের বৈধতাও হ্রাস পাইতে বাধ্য। অফিসাররা কাহার কাছে ফাইল লইয়া ছোটাছুটি করিবেন, মন্ত্রীর কাছে, নাকি তাঁহার উপদেষ্টার কাছে? মন্ত্রীর অনুমোদিত ফাইল উপদেষ্টা দেখিতে চাহিলে কিংবা দেখিয়া মন্ত্রীর নির্দেশ নামঞ্জুর করিলেই বা আধিকারিকরা কাহার কথা শুনিবেন? উপদেষ্টারা মন্ত্রীদের কাজে নাক গলাইবেন না, ইহা আশা করাও ঠিক নয়। কিছু তো তাঁহাদের করিতেই হইবে, অন্তত কিছু উপদেশ তো বিতরণ করিতে হইবেই। সে-উপদেশ যদি মন্ত্রীর পছন্দ না হয়, তখন কাহার কথা থাকিবে, মন্ত্রীর, না উপদেষ্টার? প্রশাসন কি এই সব লইয়া মহা সঙ্কট ও জটিলতার আবর্তে পড়িয়া যাইবে না? আর যদি দেখা যায়, উপদেষ্টাদের তেমন কোনও কাজ নাই, তাঁহাদের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব গিয়াছে বলিয়া মহাকরণে খানিক বসিবার, গল্পগুজব করিবার, কফি-কাজুবাদাম সেবনের এবং নেত্রীসকাশে যখন-তখন ‘হাজির’ থাকার কর্তব্য পালনের সুবিধা করিয়া দিতেই সচিবালয়ে ঘর-দোর, অফিসার-খাজাঞ্চি, বেয়ারা-আর্দালির বন্দোবস্ত, তবে সেটাকেও মানবসম্পদের সমূহ অপচয় গণ্য করা ভুল হইবে না। প্রধানমন্ত্রীর যেমন নিজস্ব উপদেষ্টামণ্ডলী আছে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীরও অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা-পর্ষৎ আছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও ইচ্ছা করিলে তেমন উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ করিতেই পারেন। একা হাতে এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক তিনি আগলাইয়া আছেন যে সে ধরনের উপদেষ্টামণ্ডলী তাঁহার দরকারও হইতে পারে। তাঁহার নিজেরই কথায়-- ‘ভূতের মতো খাটিতে হইতেছে’। এই যুক্তিতেই তিনি ভাবিতে পারিতেন উপদেষ্টামণ্ডলীর কথা, যাঁহারা কেবল অনুগত দলীয় ব্যক্তিত্ব নহেন, প্রসাদপ্রত্যাশী সমর্থক নহেন, তাহার অপেক্ষা বেশি কিছু, বিভিন্ন বিভাগে উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হওয়া ও উপদেশ দিবার মতো বিষয়গত সামর্থ কিংবা জ্ঞান যাঁহাদের রহিয়াছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁহারা ব্যুরোক্র্যাট পদাসীন হইতেও পারেন, কিংবা সম্পূর্ণ প্রশাসন-বহির্ভূত ব্যক্তিও হইতে পারেন, যাঁহাদের কোনও একটি বিষয়ে প্রশ্নাতীত যোগ্যতা রহিয়াছে। অর্থাৎ উপদেশ গ্রহণে ক্ষতি নাই, কিন্তু যিনি যোগ্য, তিনিই তো কেবল উপদেশ দিতে পারেন। যে কোনও ব্যক্তির উপদেশ তো বাঞ্ছনীয় নয়, তাহার বিপদও তো চতুর্গুণ! সত্যই যদি প্রশাসনকে কর্মক্ষম করিতে চাহেন মুখ্যমন্ত্রী, সে ক্ষেত্রে দক্ষ ও যোগ্য উপদেষ্টার কথা ভাবুন। তাঁহারও কাজের সুবিধা হইবে, রাজ্যেরও মঙ্গল হইবে। |