চিদম্বরম যেন ক্রিস গেইল। সব বলই উড়িয়ে খেলছেন। আর এক-দুই নয়, শুধু চার আর ছয়।
হঠাৎ খেলার কৌশল পরিবর্তনে মদত আছে ‘সংস্কার একাদশ’-এর অধিনায়ক মনমোহন সিংহের। সক্রিয় সমর্থন আছে ‘নন প্লেইং ক্যাপ্টেন’ সনিয়াজিরও। ফলে বিরোধী দলের বাউন্সারগুলিকে আদৌ সমীহ করছেন না চিদম্বরম। একের পর এক ঘোষণা করে চলেছেন বহু দিন ধরে আটকে থাকা বিভিন্ন সংস্কারের কথা।
অপ্রত্যাশিত ভাবে একই সঙ্গে ভিন্নমুখী এক ঝাঁক সংস্কারের প্রস্তাব পেশ হওয়ায় প্রতিপক্ষের ‘বোলাররা’ যেন কিছুটা দিশেহারা। চিদম্বরমের ইঙ্গিত, খেলা একই ভাবে চলবে শেষ ওভার পর্যন্ত। প্রণববাবু মন্ত্রিসভা থেকে এবং তৃণমূল সরকার থেকে সরে যাওয়ায় শিকলমুক্ত হয়ে রাতারাতি খেলার ধারা পাল্টে ফেলেছে মনমোহন সরকার। এই খেলায় মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছেন অর্থ মন্ত্রকে ফিরে আসা পি চিদম্বরম।
দেশের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও বিদেশি লগ্নিকারীরা এতে বেজায় খুশি। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে খুচরোয় বিদেশি বিনিয়োগ, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিমা এবং পেনশনে বিদেশি লগ্নি বৃদ্ধি-সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সিদ্ধান্ত বোধহয় বিদেশিরাও আশা করেনি। এদের উল্লাস প্রকাশ পাচ্ছে শেয়ার বাজারে ডলার বৃষ্টির মাধ্যমে। এর প্রভাবে পনেরো মাস পরে গত সপ্তাহে সেনসেক্স আবার টপকেছিল ১৯ হাজারের বাধা। ডলার প্রবাহ বেড়ে ওঠায় দ্রুত বাড়ছে টাকার বিনিময়মূল্য। কমছে সোনার দাম। সংস্কারের ব্যাপারে মতামত যা-ই হোক, শেয়ার এবং মিউচুয়াল ইউনিটের দাম দ্রুত বেড়ে ওঠায় খুশি দেশের লগ্নিকারীরাও। অনেকেই ঘর গুছিয়ে নিচ্ছেন এই সুযোগে। শুক্রবার বাজার কিছুটা নামে লাভ ঘরে তোলার তাগিদেই।
শনিবার সেবি কর্তাদের সঙ্গে বসেছিলেন চিদম্বরম। বৈঠকে বিদেশি লগ্নিকারীদের ঋণপত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের পরিধি। সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শেয়ার ছাড়াও নতুন ধরনের লগ্নিপত্র রাখা যাবে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে। যেমন ফিক্সড ডিপোজিট, বিমা -পত্র ইত্যাদি। বাজারের পক্ষে এই সব সিদ্ধান্ত সদর্থক।
সব মিলিয়ে বাজারে আবার নতুন করে লগ্নি-সহায়ক আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, বাজারের উত্থানে মূলত অংশগ্রহণ করেছে বিদেশি পরিযায়ী পাখিরা। আবহাওয়া একটু খারাপ হলেই এরা প্রস্থান করতে পারে। বাজারকে পাকাপাকি ভাবে মজবুত করতে হলে বিদেশি লগ্নিকারীদের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। বিরাট সংখ্যায় দেশি লগ্নিকারীকে বাজারে যোগদান করতে হবে। শেয়ার বাজারে লগ্নির তুলনায় এফডিআই-এর পথে বিদেশিদের লগ্নিতে অনেক বেশি স্থায়িত্ব আছে। সরাসরি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা সংশ্লিষ্ট সংস্থায় দীর্ঘ মেয়াদের জন্য লগ্নি করে, যোগদান করে পরিচালনা এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে রাতারাতি লগ্নি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা এক রকম থাকে না বললেই চলে।
আর কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক তথা ষাণ্মাসিক কোম্পানি ফলাফল প্রকাশের পালা। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক ফলাফলে যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বিক্রি এবং লাভ দুই-ই বাড়বে বেশির ভাগ নিফ্টি কোম্পানির। তা যদি ঘটে, তবে শেয়ার সূচক শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে বৃষ্টির ঘাটতি অনেকটাই কমেছে। এইটিও বাজারের কাছে একটি বড় সুখবর।
আগামী ৩০ অক্টোবর আবার ঋণনীতি পর্যালোচনা করবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সরকার যেহেতু সুদ কমানোর পক্ষে, সেই কারণে নতুন করে আশা জেগেছে লগ্নিকারীদের মনে। তবে বাদ সাধতে পারে তীব্র পণ্যমূল্য-বৃদ্ধির হার। ডিজেলের দাম বাড়ায় পণ্যমূল্য যে আরও বাড়তে পারে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন স্বয়ং চিদম্বরম। আর্থিক সংস্কার নিয়ে ভবিষ্যতের যত উজ্জ্বল ছবিই আঁকা হোক, সাধারণ মানুষ কিন্তু গুরুত্ব বেশি দেন বর্তমানকেই। পেটে খেলে তবে সংস্কার সয় এই কথা মাথায় রাখতে হবে সরকারকে।
এফডিআই-এর পথ প্রশস্ত হচ্ছে বলে তার মানে এই নয়, রাতারাতি প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে দেশ ভরে যাবে। যে-সব বিদেশি সংস্থা দীর্ঘ মেয়াদে ভারতে মোটা টাকা লগ্নি করার কথা ভাবছে, তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক স্থিরতার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাইবে। এরা বিশেষ করে নজর রাখবে মনমোহন সরকারের মেয়াদ শেষ হলে এ দেশে কী ধরনের সরকার গঠিত হয়, তার উপর। সংস্কার বিরোধী দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় এলে উৎসাহের বেলুন কিন্তু চুপসে যেতে পারে।
সাময়িক ভাবে বাজারের অবশ্য আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া বাকি সব শর্ত এখন বাজারের পক্ষে। অতীত দিন থেকে কার্যকর আয়কর সংক্রান্ত আইন (যাতে ভোডাফোন কোম্পানির ওপর চেপেছে পাহাড় প্রমাণ করের বোঝা) যদি শিথিল করা হয়, তবে তা-ও বড় রকমের শক্তি জোগাবে বাজারকে। এই সব আশা এবং সংস্কারে ভর করে সেনসেক্স ও নিফ্টি সর্বকালীন রেকর্ড গড়তে পারে কি না, তা-ই এখন দেখার। |