মাটির মানুষ
সংস্কৃত চর্চায় অক্লান্ত কুমারনাথ
বদ্বীপের যোগনাথতলার আকাশে নাগরিক ধুলো-ধোঁয়া অনেক কম। কুমারনাথ সন্ধ্যা আহ্নিক সেরে নাতি তপোব্রতকে নিয়ে ছাদে উঠে এলেন। আকাশ ভর্তি তারার মেলা। তারই ভিতর দিয়ে চলেছে ছায়াপথ। নাতিকে আকাশ দেখিয়ে বললেন, “টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার....।” তপোব্রত জুড়ি ধরল, “হাও আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর,”। তারপরই কচি কণ্ঠের প্রশ্ন, “তুমি শিখে গেছ আমার রাইমটা!”
“না শিখে উপায় আছে? দাদুর সস্নেহ উত্তর। তারপরই বলে উঠলেন, “বলো, সত্যম্। বলো, শিবম্। বলো, সুন্দরম্।”
“এগুলো শিখে কী হয় দাদু?” “এগুলো শিখে ডাক্তার হয়। ইঞ্জিনিয়র হয়। আর নিজের দেশকে ভালবাসতে শেখা হয়।” আকাশের নীচে, নির্জনতায় ন’বছরের নাতিকে ছুটির দিনে এ ভাবেই মুখে মুখে সংস্কৃত ভাষার পাঠদান করেন কুমারনাথ।
টি-টোয়েন্টির ফেসটিভ চলছে। কুমারনাথ নাতিকে শুধালেন, “ক্রীড়া কদা সমারদ্ধা ভবতি?” নাতি তপোব্রতর ঝটিতি উত্তর, “হাফ পাস্ট সেভেন।”
“দাদু, আজ একটু বেশি শীত।” কুমারনাথ অনুবাদ করলেন দেবভাষায়, “অদ্য শৈত্যম্ কিঞ্চিৎ অধিকম্।” ছাদ থেকে নেমে আসছেন তিরাশির কোঠা পেরিয়ে আসা কুমারনাথ ভট্টাচার্য। সামনে সামনে চলা আগামী প্রজন্ম তপোব্রতর সাবধানবাণী, “বি কেয়ারফুল দাদু, অ্যাট এভরি স্টেপস।” পাশের ঘরে তপোব্রত হোমটাস্কে। কুমারনাথ ফলাহার সেরে গীতা পাঠে বসলেন। মূল পুরুষ গোবিন্দরামকে ধরলে চোদ্দোতম পুরুষ ধরে সংস্কৃত ভাষা চর্চায় একনিষ্ঠ ভট্টাচার্য পরিূবার। কিন্তু কালের বহমানতায় আধুনিক চিন্তা-ভাবনা, প্রযুক্তির চাপ ক্রমাগত বেড়ে চলায় এই চর্চা কি পরবর্তীতেও বজায় রাখা যাবে, নাকি পনেরোতম পুরুষেই শেষ হবে?
প্রশ্নটা শুনে ইজিচেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেন কুমারনাথ। একটু পরে শুরু করেন, “আমি তো স্কুল কলেজে গেছি অনেক বেশি বয়সে। বাড়ির টোলেই জীবনের প্রথম পাঠ। জন্মেছিলাম বারাণসীর কেদারঘাটে। সেখান থেকে পালকপিতা (আসলে আমার কাকা) চলে এলেন মুর্শিদাবাদের নিমতিতায়। দশ মাস বয়সে মা-র (আসলে কাকিমার) কোলে। নিমতিতার জমিদার রায়বাহাদুর জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণদের শিক্ষাসত্রে। পালকপিতা উপেন্দ্রনাথ সাংখ্যতীর্থের ‘রাধাবল্লভী চতুষ্পাঠীতে’ আমার কৈশোর-পাঠ।
তার পর? “সেখানে উনিশ বছর বয়সে ব্যাকরণ ও কাব্য উপাধি শেষ। ম্যাট্রিকুলেশন প্রাইভেটে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বাইশ বছর বয়সে, ১৯৫১ সালে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে আই এ। কলেজে যেতে হত নগ্ন পদে, উড়ুনি গায়ে। এটাই ছিল পরিবারে ছাত্রদের পোশাক। নবদ্বীপের কলেজ থেকে স্নাতক। অনার্স তখনও খোলেনি। স্নাতকোত্তর ১৯৫৬ সালে। প্রাইভেটে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগুলার ছাত্র হিসেবে পড়ার অনুমতি না-মেলার কারণ, ওখানে মেয়েরা পড়তে আসে। তবে আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য দুই মায়ের (মা ও কাকিমার) অবদান স্মরণীয়।”
কিন্তু পালক পিতা, পালিকা মাতার প্রসঙ্গটা....? “আমার জন্মদাতা পিতা যাকে আপনারা বায়ো-ফাদার বলেন, তাঁর নাম কেদারনাথ সাংখ্যতীর্থ। দাদু শিবনাথ, কাশীর গঙ্গায় এক গলা জলে আমার বাবাকে দিয়ে শপথ করান, আমি জন্মালে পর যেন তা উপেন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়। কারণ আমরা একাধিক ভাই। উপেন্দ্রনাথের পুত্র সন্তান ছিল না, তাই।”
আপনাদের পরিবার তো বহুবার ভিটে বদলেছে। “তখনকার ময়মনসিংহ জেলার কাঁঠালিয়া গ্রাম। টাঙ্গাইল মহকুমা। সেখান থেকে বারাণসী। সেখান থেকে নিমতিতা। অতঃপর নবদ্বীপ। এম এ পড়ার আগে ১৯৫৪ সালে কলকাতার বালিগঞ্জের টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়াশুনা (বিটি)। হস্টেলে থাকার অনুমতি না-মেলায় কলকাতার ‘বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ সভা’র ঘরে থেকে পড়াশোনা। পাশ করে এখানে কিছুদিন চাকরি। বাকি জীবনটা হুগলির ইটাচুনা কলেজে অধ্যাপনা। সংস্কৃত চর্চার প্রবীণ এই ছাত্র এখন যুক্ত আছেন দেবনাগরী অক্ষরে ও ভাষায় প্রকাশিত ‘সত্যানন্দম্’ পত্রিকার সঙ্গে। প্রতিষ্ঠাতা, বরানগর কাচ-মন্দির খ্যাত স্বামী সত্যানন্দ। তাঁর প্রয়াণের পরে স্বামী মৃগানন্দ ও স্বামী হীরানন্দের সঙ্গে সম্পাদনা করছেন পত্রিকাটি। কলকাতার যাদবপুর থেকে প্রকাশিত মাসিক ট্যাবলয়েড। ইতিমধ্যেই যার বয়স ২৫ পেরিয়ে গিয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.