কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি প্রস্তাব করিয়াছে। প্রস্তাব এবং প্রকৃত সংস্কারের মধ্যে ফারাক আছে সংসদে পাশ না হইলে বিমা বা পেনশন ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করা যাইবে না। অর্থাৎ, বিতর্কের সুযোগ বর্তমান, এবং সেই বিতর্ক গণতন্ত্রের শীর্ষ পরিসর সংসদেই হইতে পারে। আমরা মনে করি, এই প্রস্তাবগুলি বিতর্কের অতীত। যাঁহারা এই সংস্কারের বিরোধিতা করিবেন, তাঁহারা ভারতকে আদিম প্রস্তর যুগের অন্ধকারেই বাঁধিয়া রাখিতে চাহেন। কিন্তু ভারত চিন নহে, উত্তর কোরিয়াও নহে। ভারতীয় গণতন্ত্র সেই অন্ধকারের পন্থীদেরও কণ্ঠরোধ করে নাই, তাঁহাদের মতপ্রকাশের সম্পূর্ণ অধিকার দিয়াছে। আমরাও এই অধিকারে বিশ্বাসী আমরা যাঁহাদের মতের সম্পূর্ণ বিরোধী, তাঁহাদের অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার আমাদের বিচারে অমূল্য। এইখানেই গণতন্ত্রের অপরিসীম গুরুত্ব। সুতরাং, সংসদেরও। যাঁহারা সংস্কারের বিরোধিতা করিয়া অন্ধকারের বাণিজ্যই করিতে চাহেন, তাঁহাদের কর্তব্য সংসদের আগামী অধিবেশনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। যদি সাধ্যে কুলায়, তাঁহারা সংসদে ভোটে সরকারের এই প্রস্তাবকে পরাজিত করুন। ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে তাহা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক হইবে, কিন্তু গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যরক্ষায় সেই দুর্ভাগ্য মানিয়া লইতে ভারত প্রস্তুত।
অন্ধকারের ব্যাপারিরা কি গণতন্ত্রের পরিসরকে ব্যবহার করিতে যোগ্য, প্রস্তুত, সম্মত? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই ফেসবুকে জেহাদ ঘোষণা করিয়াছেন। অনুমান করা চলে, তাঁহার অনাস্থাপ্রস্তাব ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না তাহা ক্রমে মেট্রো চ্যানেল, যন্তর মন্তর হইয়া মিছিল, সমাবেশ, ধরনার মেঠো রাজনীতির স্তরে নামিয়া আসিবে। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় আগের দফায় বামপন্থীদের পালের হাওয়া সম্পূর্ণ কাড়িয়া লইয়াছিলেন। এই দফায় বামপন্থীরা ফের কোমর বাঁধিবেন, এবং রাস্তার রাজনীতির খেলায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাইবার চেষ্টা করিবেন। অন্য যে দলগুলি এই সংস্কারের বিরোধী, তাঁহারাও রাস্তার রাজনীতিকেই ধ্রুব মানেন। অর্থাৎ, বিরুদ্ধ মত পেশ করিবার, ভিন্নমত হইবার যে পরিসর গণতন্ত্র দিয়াছে একমাত্র গণতন্ত্রই যাহা দিতে পারে তাহাকে আগ্রহ্য করিয়া হাততালি কুড়াইবার রাজনীতি চলিবে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের সহিত সাযুজ্য রাখিয়া আগামী অধিবেশনেও সংসদ অচল থাকিবে বলিয়াই আশঙ্কা হয়। আর সংসদ যদি চলেও, তাহাতে কি সুস্থ, সমৃদ্ধ বিতর্ক হইবে? আশঙ্কা হয়, গণতন্ত্রের শীর্ষ পরিসরেও মেঠো রাজনীতিই সত্য হইবে। বিতর্কের বদলে চিৎকার চলিবে, যুক্তির বদলে গা-জোয়ারিই জয়ী হইবে। ভারত এখনও গণতন্ত্রের যোগ্য হইয়াছে কি না, এই প্রশ্নটি আরও এক বার অনিবার্য হইবে।
অথচ, গণতন্ত্রে কী বিপুল সম্ভাবনা নিহিত আছে, তাহার একটি উদাহরণ বর্তমান ঘটনাক্রমেই রহিয়াছে। ইউ পি এ সরকারের প্রধান বিরোধী বিজেপি সংসদের দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা যাহাদের অবদান হয়তো সংস্কারের প্রশ্নে কংগ্রেসকে সমর্থন করিতে পারে। তাহাদের কিছু শর্ত আছে। তাহারা চাহে, সরকার তাহাদের সহিত আলোচনা করুক, তাহাদের এই সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ার শরিক করুক। অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদম্বরমও অন্তত প্রাথমিক ভাবে এই প্রস্তাবে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছেন। সংস্কারের প্রশ্নে সত্যই যদি কংগ্রেস ও বিজেপি পরস্পরের সহযোগী হয়, তাহা ভারতীয় গণতন্ত্রে একটি দিকচিহ্ন হইতে পারে। এই সম্ভাবনা তৈরি হইয়াছে, কারণ বিজেপি-র একটি অংশ সংস্কারে বিশ্বাসী। সেই অংশটি যদি দলের অবশিষ্টাংশকে সংস্কারের গুরুত্ব বুঝাইতে পারে, তবে হয়তো ইতিহাস রচিত হইবে। গণতন্ত্রই এই সম্ভাবনা তৈরি করিয়াছে। বেশির ভাগ দলের অভ্যন্তরেই এমন বহুমুখী মতামতের স্রোত বহমান। কয়টি দলই বা আর তৃণমূল কংগ্রেস হয়! এই ক্ষেত্রেও তৃণমূল বামপন্থীদের সঙ্গে পাইয়াছেন। তাঁহারাও দলবদ্ধ ভাবে জুরাসিক যুগের বাসিন্দা। এই দুইটি দলের কথা থাকুক। বাকি দলগুলি চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারে, গণতন্ত্র তাহাদের যে সুযোগ দিয়াছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাইয়া ভারতকে নূতন যুগের ভোরে লইয়া যাওয়া যায় কি না। |