ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ পিছিয়ে দিতে চেয়ে রাজ্য সরকারের করা আবেদন খারিজ করে দিল কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। তারা জানিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের অনুরোধ মেনে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত স্থগিত রাখা সম্ভব নয়। নির্ধারিত সূচি মেনেই ১ অক্টোবর থেকে সেই কাজ শুরু হবে এবং তা মাসভর চলবে। কমিশনের সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আনার যে পরিকল্পনা করেছিল, তা ধাক্কা খেল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত আসলে চক্রান্ত। এমনিতেই ইউপিএ সরকার তথা কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের তিক্ততা চরমে। কাল, সোমবার দিল্লিতে কেন্দ্র-বিরোধী প্রতিবাদে সামিল হওয়ার কথা মমতার। এই রাজনৈতিক আবহে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে সঙ্ঘাতের আরও একটি ক্ষেত্র তৈরি হল। কারণ মমতা চান, আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সেরে ফেলতে। কিন্তু কমিশনের আজকের সিদ্ধান্তের ফলে ওই সময়ে পঞ্চায়েত ভোট করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “কমিশনের সিদ্ধান্তে আমাদের সুবিধাই হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক পঞ্চায়েত ভোট করানোর ব্যাপারে রাজ্য বদ্ধপরিকর।”
রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে কমিশনকে অনুরোধ করেন, এ রাজ্যে ১ অক্টোবর থেকে ভোটার তালিকা সংশোধনের যে সূচি রয়েছে, তা পিছিয়ে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের পর করা হোক। কমিশন শনিবার মুখ্যসচিবকে জানিয়েছে, রাজ্যে এমনিতেই এখন পঞ্চায়েত ভোটের জন্য সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ চলছে। কমিশন ২ জানুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করছে। রাজ্য চাইলে তার পরে পঞ্চায়েত ভোট করতেই পারে। এ দিন কমিশন তাদের নির্ধারিত সূচি কিছু পরিবর্তন করেছে। সংশোধিত সূচিতে আগামী বছরের ১৫ জানুয়ারির পরিবর্তে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের দিন ধার্য হয়েছে ২ জানুয়ারি। আগের সূচিতে ১ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর এবং ৩০ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার তালিকা সংশোধনের কথা ছিল। যার অর্থ, দুর্গাপুজোর সময় তালিকা সংশোধনের কাজ ১০ দিন স্থগিত রাখার কথা ছিল। কমিশনের নতুন সূচি অনুযায়ী, ১ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ চলবে।
এমনিতেই কমিশনের সিদ্ধান্তে বেজায় চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর তাদের পরিবর্তিত সূচি নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখেননি তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় দিল্লি যাওয়ার আগে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময় ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ চলবে? এটা মেনে নেব না। রাজ্যের বিরুদ্ধে দিল্লির চক্রান্ত চলছে’। মুখ্যসচিব বলেন, “ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। উৎসবের মরশুমের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য রাজ্য আবার তাদের লিখতে পারে। তবে পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতির কাজ একই সঙ্গে আপাতত চলবে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন যেমন চাইবে, ভোট প্রস্তুতি সে ভাবেই এগোবে।”
এ দিনই মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের যুগ্ম-সচিব তাপস চৌধুরীকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব পদে বদলি করা হয়েছে। সাধারণত এই পদে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদেরই পুনর্নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের কয়েক মাস আগে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক অফিসারকে সেখানে বদলি করা হল, তাতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরেও যে মহাকরণের নজরদারি বহাল থাকবে, তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনের কমিশনের এ দিনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে কংগ্রেস ও সিপিএম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য যখন নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তখন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, “এ ঘটনা প্রমাণ করে, যাঁরা রাজ্যের পরিচালনায় আছেন, তাঁরা সাংবিধানিক সংস্থা পরিচালনার অ-আ-ক-খ জানেন না।”
প্রশাসনিক মহল মনে করছে, ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ এখন চালিয়ে যেতে হলে পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ২ জানুয়ারি ভোটার তালিকা প্রকাশ হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ভোট করাতে হলে মাধ্যমিক পরীক্ষা অন্তত সপ্তাহ দুয়েকের জন্য পিছিয়ে দিতে হবে। তার ফলে পিছিয়ে দিতে হবে উচ্চ-মাধ্যমিকও। তাতে ফল প্রকাশ পিছিয়ে গিয়ে শিক্ষাবর্ষ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সর্বোপরি এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলে লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও চিন্তিত সরকার। |