মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন তাঁর খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে দিল্লিতে পা রাখলেন, সে দিনই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আরও এক বার স্পষ্ট করে দিলেন, সংস্কার প্রশ্নে পিছু হটার কোনও প্রশ্ন নেই। তাঁর কথায়, “সংস্কারই একমাত্র পথ নয়। তবে দেশের ভালর জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করবে সরকার।” সেই সঙ্গে প্রকারান্তরে এ-ও বুঝিয়ে দিলেন, সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি নিশ্চিত। তাঁর মন্তব্য, “নির্বাচনের এখনও অনেক দেরি।”
মমতাও নিজের অবস্থানে অনড়। শনিবার দিল্লি রওনা হওয়ার আগে ফেসবুকে তিনি ফের বলেন, “সংস্কার এবং আম-আদমির নামে লুঠ চলছে, লুঠ।” যে দিন ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসে তৃণমূল, জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে ‘আম-আদমির’ স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রের ভূমিকার কথা বলেছিলেন মনমোহন। সে দিনও প্রধানমন্ত্রীর নাম না করে ওই শব্দগুলিকে ধরে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ দিন তারই পুনরাবৃত্তি করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সমর্থন তোলার পরে এই প্রথম দিল্লি এলেন মমতা। ঠিক সে দিনই তাঁকে নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হল মনমোহনকে। সম্প্রতি এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীকে নকল করে দেখিয়েছেন মমতা। সে সম্পর্কে কিছু বলতে তো চানইনি, উল্টে তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মনমোহন বলেন, “কারও প্রতি আমার তিক্ততা নেই।”
তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, মার্কিন প্রশাসনের চাপে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগ শোনা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপি গলাতেও। মনমোহন এ দিন বলেন, “কারও অঙ্গুলিহেলনে চলে না ভারত।” বস্তুত, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির সময়েও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর সচিবালয়ের এক কর্তার কথায়, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দেওয়ার পিছনে সনিয়া-রাহুল গাঁধী সব গোটা কংগ্রেস পার্টির সায় রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জনস্বার্থ বিরোধী হবে বলে আঁচ করলে অন্তত কংগ্রেস তাতে সায় দিত না।
তৃণমূল নেত্রী অবশ্য সরকারের কোনও রকম যুক্তিই শুনতে নারাজ। আজ তিনি দিল্লি যাওয়ার আগে সেখানকার কর্মসূচির জন্য তৃণমূলের তরফে যে নোট তৈরি করা হয়েছে, তাতেও রয়েছে কড়া চ্যালেঞ্জের ছাপ। বলা হয়েছে, দেশকে বিকিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় চক্রান্ত তাঁরা রুখবেন। দু-পাতার ওই নোটে উত্তরপ্রদেশ থেকে আর্জেন্তিনা নানা উদাহরণ দিয়ে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মমতা তুলে ধরতে চেয়েছেন সারা বিশ্বের ছবি। সেই সঙ্গে গোটা দেশকে এক আন্দোলনের সুতোয় বাঁধতে রয়েছে সিঙ্গুর থেকে কলিঙ্গনগরের আন্দোলন প্রসঙ্গ। ফেসবুকে মমতা এ কথাও বলেছেন: “সংস্কার বলতে এখন আর উন্নয়নকে বোঝান হয় না। যে কোনও সিদ্ধান্ত, যা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যায় তাঁকেই সংস্কার বলা হচ্ছে।” |
আবার বিরোধী:
ইউপিএ ছাড়ার পর প্রথম বার দিল্লির পথে মমতা। —নিজস্ব চিত্র |
নোটে এশিয়ার বৃহত্তম অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদক সংস্থা ন্যালকোকে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের আওতায় আনার নিন্দা করা হয়েছে। এক সময় এই কথাগুলো দিনের পর দিন বামেদের মুখে শোনা যেত। রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের অনেকেই মনে করেন, মমতা বামেদের পথে হাঁটছেন বলেই তাঁর মুখেও কথাগুলো ফিরে আসছে। ফিরে আসছে বামেদের মতো আন্তর্জাতিক উদাহরণও। কী ভাবে? নোটে বলা হয়েছে, আর্জেন্তিনা এক সময়ে দেশের খুচরো বাজার খুলে দিয়েছিল বিদেশি সংস্থার কাছে। অথচ ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সে দেশে ৬৪ হাজারের বেশি দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একই ভাবে চিলিতে প্রায় ২০% দোকান বন্ধ হয়েছে বিদেশি পুঁজির জন্য। ভারতে এই অবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় তৃণমূল। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনেরও উল্লেখ রয়েছে তৃণমূলের ওই নোটে। বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, এফডিআই এলে হুগলির সেরা আলু অথবা উত্তরপ্রদেশের সর্ষে চলে যাবে বিশ্ববাজারের অন্য প্রান্তে।
মমতা যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরের দরজায় এসে আন্দোলন শুরু করছেন, তেমনই কংগ্রেস নেতৃত্বও প্রদেশ শাখাকে মমতার পাড়ায় ঢুকে পাল্টা প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, কৌশলগত ভাবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মমতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে চাইছেন না। মমতা প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সম্পর্কে ‘কুরুচিকর’ মন্তব্য করলেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অবস্থান হল, সরকার নীতিগত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা তৃণমূলের পছন্দ হয়নি। তাই তারা জোট ছেড়েছে। সে জন্য মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রশ্ন নেই। এর ফলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস ও তৃণমূলের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের তুলনাটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে রাজ্যস্তরে তৃণমূলকে কোনও ছাড় দিতে চাইছে না কংগ্রেস। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন। তার আগে তৃণমূল কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যতটা সুর চড়াবে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অরাজকতা নিয়ে কংগ্রেস ততোধিক চড়া সুরে আক্রমণ করবে তৃণমূলকে। |