এলপিজি-র বাড়তি দামের জেরে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা কলকাতা-সহ কিছু এলাকার মিড ডে মিল প্রকল্প ঘিরে।
ছ’টির বেশি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের উপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। এই ব্যবস্থা চালু হলে শুধু কলকাতার স্কুলগুলিতেই রান্না করা খাবার দিতে কার্যত নাভিশ্বাস উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকী রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের ধারণা, গ্যাস ব্যবহারের এই নতুন নিয়ম চালু হলে মিড ডে মিল প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
এই আশঙ্কা থেকে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিব। মিড ডে মিল প্রকল্পের জন্য গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়া না হলে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে চিঠিতে জানান তিনিও। শিক্ষা দফতরের মতে, কলকাতায় এই প্রকল্প সবচেয়ে বেশি সঙ্কটের মুখে পড়বে। কারণ এখানে সব স্কুলের রান্নাই হয় গ্যাস সিলিন্ডারে।
রান্না করা খাবার পায়, কলকাতায় এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। শহরের ১৬৫০টি স্কুলের মাধ্যমে তাদের খাবার দেওয়া হয়। আর এই খাবার রান্না করতে গ্যাস সিলিন্ডার লাগে কম করে ১০ হাজার। প্রতি মাসে। স্কুলশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “গোটা রাজ্যে রান্না খাবার তৈরি করতে কত গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, তার হিসেব পরিষ্কার নয়। তবে সংখ্যাটা যা-ই হোক, বিপদটা তার থেকেও বেশি। কারণ অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটাই না বন্ধ হয়ে যায়।”
১৯৯৫ সালে চালু হওয়া মিড ডে মিল প্রকল্পে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। এ জন্য প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র-পিছু দিনে ৩ টাকা ৩৩ পয়সা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-পিছু দৈনিক গড়ে ৪ টাকা ৬৫ পয়সা দেয় কেন্দ্র। এর মধ্যে জ্বালানির খরচও ধরা থাকে। এত কম টাকায় কী করে ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। এ বার সিলিন্ডারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেলে এই প্রকল্প কী ভাবে চলবে, সেটাই ভাবছেন শিক্ষক-আধিকারিকদের একাংশ।
কলকাতার ৪৮টি স্কুলে খাবার পৌঁছে দিতে ‘যৌথ রান্নাঘর’ চালায়, এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে মধুমিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, “বরাদ্দ টাকায় এমনিতে কুলোয় না। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বরাদ্দ একটু বেশি থাকায় কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে ৯০০ টাকারও বেশি দামে সিলিন্ডার কিনে খাবার রান্না করা সম্ভব নয়।” বেথুন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শুক্লা রায় বলেন, “অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত খাবার দেওয়ার কথা হলেও আমরা সব মেয়েকেই খাবার দিই। এ জন্য শিক্ষিকারাই কিছু চাঁদা দেন। কিন্তু এক লাফে গ্যাসের দাম অতটা বেড়ে গেলে তো শিক্ষিকাদের পক্ষে টাকা দিয়ে প্রকল্প চালানো সম্ভব নয়। সরকারকে এ ব্যাপারে একটা কিছু করতেই হবে। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সেটা জানিয়েছি।” ওই স্কুলে মাসে আটটি সিলিন্ডার লাগে।
শুধু কলকাতার স্কুলগুলিই নয়, শিলিগুড়ির সমস্যা অনেকটা এক রকম। দুর্গাপুর নিয়েও উদ্বিগ্ন স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তারা। কোচবিহারে ১০০টি স্কুলে কাঠকয়লার বদলে গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না চালু করার কথা ভাবা হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সেই পরিকল্পনা বাতিল করার উপক্রম হয়েছে। কোচবিহার জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে ওই জেলায় ১০০টি স্কুলে রান্নার গ্যাস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, স্কুলগুলির পরিকাঠামো ও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা যাচাই করে দমকল কর্তারা শংসাপত্র দিলে তবে ওই ব্যবস্থা চালু করা যাবে। দমকল সমীক্ষার কাজ শুরুও করেছে। কিন্তু সিলিন্ডারের উপরে ভর্তুকি বেঁধে দেওয়ায় এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
কলকাতা জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কার্তিক মান্না অবশ্য জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ভাবনাচিন্তা করছে। কিন্তু তিনি যা-ই বলুন, অনেকের গলাই তেমন আশ্বস্ত শোনাচ্ছে না। বর্ধমান জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান স্বপন ঘোষ বলেন, “নামমাত্র বরাদ্দে কী ভাবে মিড ডে মিল প্রকল্প চালু রাখা হয়েছে, তা শিক্ষকেরাই জানেন! সিলিন্ডারে ভর্তুকি বন্ধ হলে প্রকল্প চালু রাখা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।” |