|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অন্ত্যজ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত |
অরবিন্দ সামন্ত |
কাস্ট, প্রোটেস্ট অ্যান্ড আইডেন্টিটি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া: দ্য নমশূদ্রজ অব
বেঙ্গল, ১৮৭২-১৯৪৭, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। অক্সফোর্ড, ৮৪৫.০০
|
এ দেশের ইতিহাস-আখ্যানে জাতি ও জাতীয়তাবাদের উদ্ভব নিয়ে বহু বাদানুবাদ হলেও জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক উপাখ্যানের বড়ই অভাব ছিল। জাতের বজ্জাতি নিয়ে সাহিত্য আছে, কিন্তু জাতের সামাজিক ইতিহাস ছিল বাড়ন্ত। সেই অভাব পূরণে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় যে একনিষ্ঠ উদ্যম দেখিয়েছেন, তারই ফল এই ক্লাসিকধর্মী গবেষণাগ্রন্থটি। নমঃশূদ্র জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থটি বিলেত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বছর পনেরো আগে। গ্রন্থটি মহার্ঘ্য, ফলত দুর্লভ ছিল এ দেশে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের এই সংশোধিত-সংযোজিত সংস্করণটি সহজলভ্য হওয়ায় উৎসাহী পাঠক গ্রন্থটি সংগ্রহ করতে পারবেন।
আমাদের জাতীয় আন্দোলন ছিল প্রধানত উঁচু জাতের কাজিয়া। গাঁধীর যোগদান এই আন্দোলনে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল, কিন্তু সেই পরিবর্তন ছিল নিতান্তই প্রসাধনিক। সাবেক ইতিহাসরচনা এই প্রান্তকায়িত অন্ত্যজ গোষ্ঠীর ব্যাপারে নীরব থাকলেও সাম্প্রতিক কালে উনিশ শতকের নিম্নবর্গীয় ও অস্পৃশ্য মানুষদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়েছে। পরস্পর-বিরোধী প্রধানত দু’ধরনের ব্যাখ্যা মিলেছে। এক: অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন সর্বজনীন ছিল না। আসলে অন্ত্যজদের মধ্যে যারা আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন, তারাই সামাজিক ঊর্ধ্বায়ণের অভিলাষে আন্দোলনমুখী হয়েছিল। এরা শুরুতে উচ্চবর্ণের সামাজিক মর্যাদার প্রতীকচিহ্নগুলি আত্মস্থ করতে চেয়েছিল; শেষে তাদের দৃষ্টি শুধু প্রতীকেই নিবদ্ধ থাকেনি, ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষা ও চাকুরির মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখলের দিকেও ধাবিত হয়েছিল। দুই: অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন আসলে আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। নিম্নবর্ণের অন্তর্গত সামাজিক নিকৃষ্টতা ভাবনাই জাতি-আন্দোলনে প্ররোচনা দিয়েছে। সুতরাং, শেষ বিচারে, এই আন্দোলন প্রচলিত হিন্দু জাতি-কাঠামোর বিরুদ্ধেই ঘোষিত হয়েছিল।
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই অভিমতের কোনওটিকেই পুরোপুরি সত্য বলে মানেননি। তাঁর মতে, প্রথম ব্যাখ্যায় অন্ত্যজ গোষ্ঠীর আন্দোলনে প্রতিবাদের আখ্যানটি পুরোপুরি আড়াল হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় ভ্রান্ত ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, একটি অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠী অবিমিশ্র মানুষের সুষম সমাহার, একই সামাজিক পরিস্থিতিতে, একই বৌদ্ধিক চৈতন্যে, একই সামাজিক সম্পদের ভোগের ভাগীদার কিংবা দুর্ভোগের শিকার। জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে এই একশৈলিক আকার-প্রকার ভাবনা অনৈতিহাসিক, কেননা ঔপনিবেশিক শাসনকালে প্রতিটি অন্ত্যজ গোষ্ঠী তাদের সামাজিক আচার-আচরণের অভিন্নতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় আলাদা ছিল।
নমঃশূদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবাদী আন্দোলন ও আত্মপরিচয় আলোচনাকালে লেখক দেখিয়েছেন অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর আন্দোলন অর্থের রিক্ততা কিংবা বিত্তের অতিরিক্ততা কোনও অবস্থান থেকেই নিরঙ্কুশ ভাবে উৎসারিত হয়নি। এমনকী কোনও জাতিগোষ্ঠী নিছক রাজনৈতিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠাকল্পেই জাত-চিহ্নকে ‘প্রতীকী মূলধন’ হিসেবে ব্যবহার করেনি। পরিস্থিতিটি ছিল যথেষ্ট জটিল এবং বহুমাত্রিক। জাতিগোষ্ঠীর জীবনচর্যায় বিধৃত সামাজিক প্রান্তিকতার যাবতীয় চিহ্ন আরও তীক্ষ্নতর হয়ে গোষ্ঠীর সামূহিক পরিচয়কেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারপর সেই গোষ্ঠী যখন তাদের নিজস্ব জনজীবনের লৌকিক কল্পকথা ও বীরগাথা উদ্ভাবন করে গোষ্ঠী-পরিচয়কে সুনির্দিষ্ট আকার দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তখন উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধেছে।
এই ঐতিহাসিক সত্যকেও লেখক নিরঙ্কুশ মনে করেননি। কেননা, তিনি লক্ষ করেছেন একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবাদী উচ্চারণ এক ও অভিন্ন থাকেনি। সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বিষম স্ববিরোধ মাঝে মাঝেই বৈরিতার সৃষ্টি করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের শেষের দিকে একটি অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠী কী ভাবে প্রতিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের ‘নমঃশূদ্র’ নামে স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণ করেছিল। আবার, কী ভাবে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেই জনগোষ্ঠী তাদের স্বাতন্ত্র্য এবং অস্মিতা হারিয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্রোতে অন্তর্হিত হল।
ঔপনিবেশিক বাংলায় নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু জাতিগোষ্ঠী এবং পূর্ব বাংলার বৃহত্তম হিন্দু কৃষক সম্প্রদায়। আবার, নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন ঔপনিবেশিক বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী তফসিলি জাতি-আন্দোলন। নমঃশূদ্ররা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে গত শতকের তিরিশের দশক পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ঐতিহাসিকরা মানেন, এই বিচ্ছিন্নতা মুসলিম বিচ্ছিন্নতার মতোই এ দেশের জাতীয় আন্দোলনকে নানা ভাবে আহত ও দুর্বল করেছিল। লেখক সঙ্গত কারণেই তাই অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন কেন নমঃশূদ্র সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদকে বর্জন করেছিল আর কেনই বা তারা শেষ পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল।
লেখকের মতে, নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদের আখ্যানে পর্যবসিত হয়নি। পর্যায়ক্রমে কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয়তাবাদী, হিন্দু মহাসভা প্ররোচিত সাম্প্রদায়িকতাবাদী, কমিউনিস্ট অনুপ্রাণিত কৃষক জনবাদী আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের শামিল হওয়া ইতিহাসসিদ্ধ গতিশীলতারই ইঙ্গিতবাহী। নমঃশূদ্র আন্দোলনের এই ঘটমান বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, গোষ্ঠীচেতনা অবস্থানগত প্রেক্ষিতে কল্পিত এবং পরিকল্পিত হতে পারে। আবার, গোষ্ঠীর কাঠামোগত বিন্যাসে বিভিন্নতা থাকলে আন্দোলনের নির্মাণ ও বিনির্মাণেও বৈচিত্র আসতে পারে। লেখক দেখিয়েছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অগ্রণী নমঃশূদ্ররা নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অংশীদার হতে চাইলেও, প্রান্তিক নমঃশূদ্ররা সনাতন গোষ্ঠীর সম্মানরক্ষা, সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির আন্দোলনেই বেশি উৎসাহী ছিল। যে অগ্রণী নমঃশূদ্ররা বৃহত্তর জাতীয় পরিস্থিতিতে নিজেদের ক্ষমতায়ন অন্বেষণ করেছিল, তারা ১৯৩৫-এর সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্যে নিজেদের অবস্থার অনেকটা সুরাহা লক্ষ করে। ফলত অধস্তন নমঃশূদ্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। প্রান্তিক নমঃশূদ্ররাও আর ‘এলিট’ নমঃশূদ্রদের মুখাপেক্ষী ছিল না। তারাও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের লক্ষ্যে নতুন নেতৃত্বের সন্ধান করে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৪০-এর দশকে আন্দোলনের প্রতিবাদী কণ্ঠটি নিরুদ্ধ হয়ে গেল নতুন গোষ্ঠী-পরিচয়ের বিকাশের মাধ্যমে আসন্ন দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে। সাবেক আন্দোলনের কিছু নেতা অম্বেডকরের তফসিলি জাতিসংঘে রয়ে গেলেন, কিছু নেতা এলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। কৃষকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভার পতাকাতলে সমবেত হল, কখনও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভার নেতৃত্বে জঙ্গি-আন্দোলনে শামিল হল। দেশভাগের ভৌগোলিক খণ্ডতা নমঃশূদ্র জাতির আন্দোলনের ইতিহাসকে খণ্ডিত করল।
গ্রন্থটিতে একটি মূল্যবান পরিশিষ্ট সংযোজিত হয়েছে দেশভাগ-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে নমঃশূদ্র আন্দোলনের হাল-হকিকত নিয়ে। লেখক এখানে দু’টি প্রধান প্রশ্ন তুলেছেন। দেশভাগের পর যে-নমঃশূদ্ররা পশ্চিমবঙ্গে চলে এলেন, তাঁদের কী হল, তাঁদের প্রতিবাদী আন্দোলন পরিত্যক্ত হল কেন? আর, ঔপনিবেশিক বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলনের পুরোধা সংগঠন মতুয়া সংঘ ২০১০-১১-এর বঙ্গীয় রাজনীতির আবর্তে কেনই বা আবার ভেসে উঠল।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের যে ইতিহাস তিনি আমাদের শুনিয়েছেন, তা হল, অন্ত্যজ নমঃশূদ্ররা সামাজিক অবিচারের ভার বহনের ক্লান্তিকর ন্যুব্জ অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে কী ভাবে সংহতি থেকে সংঘাত, প্রতিবাদ থেকে সহাবস্থান, আর বিচ্ছিন্নতার বিমুক্তি থেকে জাতীয় সংযুক্তির ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কাহিনি। |
|
|
|
|
|