...গন্ধ এসেছে: শাড়িই অ-শেষ
পুরানো জানিয়া...
তা সে যতই জিন্স-টিশার্টে, কুর্তা, স্কার্টে বছর গড়াক, বাঙালি কন্যের পুজো মানে সেই আদি-অকৃত্রিম শাড়িই তো! অষ্টমীর সকালে লালপাড়-সাদা শাড়িতে মা-কাকিমাদের স্নিগ্ধ রূপটাই যাদের শাড়ি পরার ইচ্ছেটাকে উস্কে দিয়ে এসেছে বরাবর। অথচ মা-কাকিমাদের সময়কার চেনা শাড়িগুলোর অর্ধেকই এখন প্রায় অদৃশ্য। কোথাও সে সব শাড়ি তৈরির লোকের অভাব, কোথাও আবার চাহিদায় ভাটা সব মিলিয়ে বাজার থেকে প্রায় হারাতেই বসেছে এক সময়কার রমরমা।
হারাতে বসা সে সব শাড়িকে ফিরিয়ে আনার তাগিদটাই বেশ কিছু দিন ধরে জাঁকিয়ে বসেছে সাজের দুনিয়ায়। কেউ ফিরিয়ে আনছেন বাংলার তাঁত, কেউ অন্ধ্রের ইক্কত, কেউ বা কলমকারি। কোথাও পুরনো শাড়ির চেনা কারুকাজ ফিরছে নিখুঁত ভাবে, কোথাও আবার একে-অন্যের মিশেলে নতুনত্বের ছোঁয়া। ভরা পুজোর বাজারে শহরের বেশ কিছু স্টুডিওয় তাই চলেছে এমনই কিছু শাড়ির প্রদর্শনী।
হিন্দুস্থান পার্কের ‘বাইলুম’-এ যেমন দফায় দফায় বিভিন্ন প্রদর্শনীতে ফিরেছে সে কালের বাংলার হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি। তবে তার পরতে পরতে বিভিন্ন নকশা, নানা প্রদেশের রীতির মিশেলে নতুনত্ব এনেছেন সংস্থার ডিজাইনার দম্পতি বাপ্পাদিত্য বিশ্বাস এবং রুমি বিশ্বাস। যেমন, রাজশাহী শাড়ি। ও পার বাংলার জমিদারবাড়িগুলির নিজস্ব তাঁতিরা শাড়ির পাড়ে যে ধরনের নকশা ফুটিয়ে তুলতেন, তা ফিরিয়ে রঙিন তসর, জামদানি শাড়ি তৈরি করেছেন তাঁরা। তাঁদের সৃষ্টির তালিকায় হাজির সে কালের মুর্শিদাবাদী শাড়ি, কাঁথাকাজ, ফুলকারি, কাঞ্জিভরম, তসর, শান্তিনিকেতনী বাটিক।
বাইলুম
আছে মাহেশ্বরী শাড়িতে বাংলার পাড়ের মিশেল, টাঙ্গাইল জামদানির পুরনো রীতির অনুকরণে বড় বড় মোটিফ এবং ভারী মোটিফের শাড়িতে স্বচ্ছ আঁচলের নতুনত্ব, পশমিনা শালের নকশার অনুকরণে কাজ করা ‘নাগা বুলবুল’ শাড়ি, বাংলার তাঁতে জাপানি টাই অ্যান্ড ডাইয়ের অনুকরণে কাজের শাড়ি। আর আছে স্বাধীনতার আগেকার মোটা কাপড়ে বোনা শাড়ি, তবে সাদা খোল খোলনলচে বদলে এখন নানা রঙে সেই শাড়ির নাম ‘আবীর’।
‘বাইলুম’-এর ঐশ্বর্যে আসলে রঙের প্রাধান্যটাই চোখে পড়ার মতো, প্রদর্শনীতে ঢুকলেই যা সবার আগে নজর কাড়ে। বাপ্পাদিত্যরাও তাই বলছেন, “কলকাতাকে রঙে রঙে ভরিয়ে দিতেই আমাদের শাড়িগুলো এত রংচঙে। লালের বিভিন্ন শেড চাইছেন তিরিশোর্ধ্বারা। এ বার অবশ্য হলুদ রঙের দিকেই ঝোঁকটা বেশি। তাই আগুন রঙের বিভিন্ন শেডেও শাড়ি তৈরি করেছি আমরা। আছে গাঢ় শেডের এক রঙা শাড়িও।”
বালিগঞ্জ প্লেসের উইভার্স স্টুডিওতেও সম্প্রতি হয়ে গেল হায়দরাবাদের সংস্থা ‘ট্রান্সলেট’-এর প্রদর্শনী। তাঁরা ফিরিয়ে এনেছেন ইক্কত। অবশ্যই নতুন চেহারায়, আধুনিক ডিজাইনে। সময়ের সঙ্গে হারাতে বসেছিল এই ইক্কতও। এই সংস্থা আবার ফিরিয়ে এনেছেন হাতে তৈরি ইক্কতের সূক্ষ্ম কাজ। কালো, লাল, নীল, সাদায় কোথাও ভরাট কাজ, কোথাও বা ছোট ছোট প্যাচওয়ার্কে। সাবেক ইক্কতের কাজ, রঙের কম্বিনেশন বজায় রেখেই আনা হয়েছে নতুনত্ব। “ইক্কত মানেই রঙের নানা প্যাটার্ন আর শেড। আলাদা করে সুতোয় রং করে শাড়ি বোনার এই রীতিটাই খুব আকর্ষণীয় লাগে,” বলছেন ডিজাইনার জুটি দেব আর নীল।
ক্রাফ্টস কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর রিটেল আউটলেট ‘কমলা’ আবার পুজোর প্রদর্শনীতে ফিরিয়ে এনেছে বাংলার তাঁতের শাড়ি আর হাতে করা কলমকারি কাজের যুগলবন্দি। সাদা বেগমপুরী শাড়িতে বনশ্রী রাওয়ের দক্ষিণী কলমকারির কাজে গোটা শাড়ি জুড়ে এনেছে আলাদা আভিজাত্যের ছোঁয়া। পাশাপাশি, ফুলিয়ার তসরের আঁচলে জাফরি কাজের নতুনত্ব, প্যাস্টেল শেডে রাঙানো তসর কিংবা আগেকার সাদা খোলের শান্তিপুরী শাড়িও নজর কেড়েছে সমান তালে। এর পাশাপাশি সিল্ক, লিনেন, হাতে বোনা সুতির শাড়িতে ওড়িশার অ্যাপ্লিকের কাজ করা শাড়িও লোক টানছে ‘সাশা’র পুজোর প্রদর্শনী।
পুরনো শাড়ি নতুন চেহারায় ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন ডিজাইনার অভিষেক দত্তও। তাঁর কথায়, “আগেকার যে সব শাড়ি প্রায় হারাতে বসেছিল, সেগুলোকে ফিরিয়ে আনাটাই একটা দারুণ ব্যাপার। সেই সঙ্গে কখনও সাবেক শাড়িতে আধুনিক কাজ কিংবা বাংলার শাড়িতে অন্য প্রদেশের নকশা শাড়িগুলোতে একটা কন্টেমপোরারি লুকও আনছে। এক দিকে যেমন পুরনো শাড়ির পুনরুজ্জীবন হচ্ছে, তেমনই তার নতুন চেহারারও কদর করছেন মানুষ। এটা খুব জরুরি ছিল।”
তবে কি বান এল মরা গাঙে? পুরনো ঢেউই ফের মাত করল পুজোর বাজার? বলবেন তো আপনিই।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.