|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
মন খারাপের মুন্নার
বেপরোয়া সৌন্দর্যের চাদর জড়ানো পথের মাঝে, রহস্যময়ী
অশরীরী কুয়াশারা জড়িয়ে ধরেছে। দেখে এলেন শান্তনু চক্রবর্তী |
|
লালচে মাটির মাঝে মিশকালো পিচের রাস্তা। ঠিক তার ধারেই পেট্রোল পাম্প। ড্রাইভার সুন্দরম মুখ বাড়িয়ে ‘ফুলট্যাঙ্ক’... বাকিটা মালেওয়ালি জিলিপির প্যাঁচ। সাতসকালে ডিজিটাল মিটার ও পাম্পকর্মীর হাসিমুখ দেখে চলেছি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। সামনে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের হাতছানি। ঈশ্বরের আপন দেশে এসে, পায়ের তলার সর্ষেরা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চলেছি মেঘ-পাহাড়ের দেশে। মাথার উপরে নীল আকাশটা সদ্য রাতের আড়মোড়া ভেঙেছে। সাদা মেঘের ছেঁড়া ছেঁড়া চিঠিরা কোন ঠিকানায় উড়ে চলেছে কে জানে!
উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে ঠান্ডা। রাস্তার দু’পাশে সবুজের চাদর। আর সেই সবুজের চাদর ভেদ করে কালো পিচের সুঠাম শরীর এঁকেবেঁকে উঠে গিয়েছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের ঢালে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, মাথার উপরে নীল আকাশের অর্ধেকটায় কালো মেঘের ঘনঘটা।
|
|
ঠিক যেন হাল্লারাজার সৈনিক, যুদ্ধে চলেছে। সকালের স্নিগ্ধতা মুছে, একটা যুদ্ধের আয়োজন চাইছে হাল্লারাজার সৈনিকরা। পাহাড়ের পরের বাঁকটায় বৃষ্টি ছেঁকে ধরল। বাইরের সবুজ-শ্যামলিমা প্রকৃতির ছবিটা ততক্ষণে ‘জলরঙা’ হয়ে উঠেছে। ধীর গতিতে গাড়ি চলছে। মূর্তিমান ট্রাক, ট্যাঙ্কার হুস হুস করে পাস কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির দমক থামতেই চোখের সামনে ‘আনাইমুদি পাহাড়ে’র সুবিশাল ল্যান্ডস্কেপে, নীলচে আভাস চোখের সামনে। চলেছি ‘হাইরেঞ্জ অফ ট্রাভাঙ্কোর’-এর অতীত ইতিহাসের পাতায়। ১৫২৪ মিটারের শৈলশহরের স্বপ্নপুরীতে। বেপরোয়া সৌন্দর্যের চাদর জড়ানো পথের মাঝে, রহস্যময়ী অশরীরী কুয়াশারা জড়িয়ে ধরেছে। ফগ্ লাইটের তীব্র আলোয় সেই কুয়াশার জাল কেটে এগিয়ে চলেছি।
ঠান্ডার তীব্রতাও বাড়ছে। উপচে পড়া সৌন্দর্যের সবুজরা আরও ঘনীভূত। উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢালে দু’টিপাতা একটি কুঁঁড়ির ঠাস বুনট। তারই মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের যন্ত্রদানব। সামনে-পিছনে ডাইনে-বামে সর্বত্র সবুজের সমারোহ। দূরে নীলগিরি পাহাড়ের ঢেউ ও নীলচে রঙের ছোঁয়া। এর্নাকুলাম থেকে কোথামঙ্গলম হয়ে মুন্নারের হৃদয় ছুঁয়েছি। মুগ্ধতার মৌনী ঋষিদের ধ্যানমগ্ন প্রকৃতির মাঝে কুন্ডলা, মুদ্রাপূজা ও নাল্লাহ্যালি নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে মেঘের পালক মুন্নার। চাবাগান যেন তার মাথার মুকুট। সকাল গড়িয়ে দুপুর। একটা হিল রেস্তোরাঁয় প্রকৃতির সঙ্গে কেরলিয়ান ফুডের সঙ্গত। বেকড ফিসকারি, কোজ্জুকাট্টা, কাডালা, ইরিয়াপাম-এ কব্জি ডুবিয়ে মুন্নারে মগ্ন হলাম। ততক্ষণে এক পশলা বৃষ্টি এসে চাবাগানের দু’টিপাতা একটি কুঁড়ির ঠোঁটে স্নেহের চুম্বনে ভরিয়ে তুলেছে। বৃষ্টি থামতেই চাবাগানের পাকদণ্ডীতে। হঠাৎ ভেসে এল সুন্দর গানের সুর। |
|
সেই সুরের মূর্ছনায় যেন স্নান করছে মুন্নার। পিঠে ঝুড়ি বোঝাই ‘স্পাইস গার্ল’রা তাদের জীবনের গান গাইছে। নীল আকাশের নীচে সবুজের কার্পেট বিছানো পথে পাহাড়িয়া সুরের সিম্ফনির মধ্যে দূরে নীলগিরির ভিউপয়েন্টে সূর্যটা লুকিয়ে পড়ল। আকাশে চন্দ্রিমার উদয়। নীল চাঁদের আলোয় মখমলি সবুজেরা কালচে সোহাগ মেখেছে। মোহময়ী মুন্নার আজ চন্দ্রাহত। নীরবতা যেন কথা বলছে। এক আকাশের নীচে দুই পৃথিবী। চাঁদমাখা রাতের লক্ষ তারার ব্রিগেড আর তার নীচের কালচে সবুজ স্নিগ্ধ প্রকৃতি শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে জ্যোৎস্না আলোয় উষ্ণতা বাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে।
সোনালি ওড়না গায়ে সকাল এল। ইদুক্কি জেলার শৈলশহরে। শহর সেজে উঠছে রঙিন বৈভবে। আরও উঁচুতে এঁকেবেঁকে ‘কুণ্ডলালেক’। নদী বাঁধা পড়েছে বাঁধ-এ। পাখির কলতান, সবুজের সমারোহ সঙ্গী করে নির্মল হৃদয়ের কুণ্ডলার বুকে ভেসে পড়লাম। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি লেকের জলে। পাখির গান আর জল পাহাড়ের ছবির বুকে এক স্বপ্নিল সফরনামা। একটা হেভি ব্রেকফাস্ট তার পর আবার পাহাড়ি সৌন্দর্যের চিত্র-বিচিত্রদের সঙ্গী করে ‘টপস্টেশন’-এর বারান্দায়॥
ওহ্, ফুলের প্রসঙ্গ আসতেই মনে পড়ে গেল, নীল কুরেঞ্জির কথা। আশ্চর্য সুন্দর ফুল। সৌভাগ্য আর সুখের প্রতীক। বারো বছর অন্তর মুন্নারের আনাচে-কানাচে ছেয়ে যায়। বলা ভাল, পাহাড়ের কোল আলো করে ফুল ফোটে। ‘নীল কুরেঞ্জি’র বিরল সৌন্দর্যের রূপমুগ্ধতায় লাখো প্রেমিক-প্রেমিকারা ছুটে আসে মোহময়ী মুন্নার প্রান্তে। আবার ২০১৮ সালে পাহাড়ের কোল আলো করে ফুটবে ফুল। আসবে সৌভাগ্য, সুখের জোয়ার। অজস্র ভিউপয়েন্ট, চা-কফির ঢেউ খেলানো প্রকৃতির সবুজ বারান্দা, ব্রিটিশদের হাতে তৈরি ঘর-বাড়ি-চার্চ, মেঘকুয়াশা, বৃষ্টিমাখা ক্যানভাসকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলল গাড়ি, ঈশ্বরের নিজস্ব দেশ ছেড়ে। মেঘপালক, মেঘবালিকায় ভেজা মন বলে ওঠে‘সালাম মুন্নার’।
|
কী ভাবে যাবেন |
হাওড়া বা শালিমার থেকে ট্রেনে এর্নাকুলাম। এর্নাকুলাম থেকে
কোথামঙ্গলম হয়ে বাসে বা গাড়িতে মুন্নার আসতে হয়। |
কোথায় থাকবেন |
থাকার প্রচুর হোটেল, হোম-স্টে রয়েছে। কলকাতা থেকেও বুকিং হয়। |
কখন যাবেন |
অক্টোবর থেকে জানুয়ারি। গ্রীষ্মকালে হোটেল, গাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়। |
সঙ্গে রাখবেন |
ছাতা, বর্ষাতি, সানগ্লাস, টুপি, ঠান্ডার কাপড়। |
|
|
|
|
|
|
|