চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শিল্পের সৌন্দর্য
মরা প্রতিনিয়ত অনন্ত সৌন্দর্যের ভিতর অবস্থান করি। সেই সৌন্দর্যের দু’টি উৎস। প্রকৃতি ও মানবচৈতন্য। প্রকৃতিকে আমরা যেটুকু দেখতে পাই বা অনুভব করতে পারি, সেটা নৈর্ব্যক্তিক। শুধু গ্রহণ বা বর্জন ছাড়া মানুষের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই সেখানে। এর পাশাপাশি মানব-অস্তিত্বের প্রায় সূচনাপর্ব থেকে চলে আসছে তারই চৈতন্য উৎসারিত সৌন্দর্যের আর এক বিপুল স্রোত। সেটা গড়ে ওঠে প্রকৃতি ও মানবচৈতন্যের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। মানুষের সভ্যতা এই দু’রকম সৌন্দর্যকেই কখনও কখনও ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, এ কথা সত্যি। তবু সমগ্র মানবিক-মহত্ত্বের উৎস এই সৌন্দর্য সৃজন। এখানেই জীবন ও শিল্পের নিবিড় সংযোগ।
সিমা গ্যালারিতে প্রতি বছর শারদ-উৎসবের আগে অনুষ্ঠিত হয় ‘আর্ট ইন লাইফ’ শিরোনামে প্রদর্শনী। এ বছরও চলছে। জীবনের ভিতর শিল্পের বা সৌন্দর্যের যে নিপুণ ও বিপুল কারুকাজ, তার নানা স্পন্দনে ঋদ্ধ থাকে এই প্রদর্শনী। দৈনন্দিনতার নানা কালিমায় জড়িয়ে থাকি আমরা। এই সৌন্দর্যের ভিতরে থেকেও সব সময় একে লক্ষ বা অনুভব করতে পারি না। উৎসব আমাদের সামনের সেই আবরণ তুলে নেয়। উৎসবের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত ‘আর্ট ইন লাইফ’ প্রদর্শনীটিও তেমনি। এখানে দৈনন্দিন ব্যবহৃত নানা জিনিসের পসরা থাকে।
‘সিমা’য় আয়োজিত প্রদর্শনীর একটি ভাস্কর্য
শুধু বস্ত্রশিল্পের কথাই ধরা যাক। শাড়ির বিপুল সংগ্রহের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নারী ও পুরুষের নানা রকম পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দা, নানাবিধ আচ্ছাদন ইত্যাদি। এর ভিতরে যে বিচিত্র কারুকাজ, সেই শিল্পায়নই তো একে দৈনন্দিনতা থেকে চিরন্তনের স্পন্দনে উদ্ভাসিত করে তোলে। সেখানেই জীবন আর শিল্প মিলে যায়। মিলে যায় জীবন আর প্রকৃতিও। এই কারুকৃতি যতটা চারুশিল্পের কাছে ঋণী, চারুকলাও ততটাই গ্রহণ করে আসছে অলঙ্করণের এই ঐতিহ্য থেকে। এই পারস্পরিক আদানপ্রদানের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। বিহারের মধুবনী চিত্রের আঙ্গিকে হাতে আঁকা কিছু বস্ত্র আছে এখানে। তাতে যে ‘মোটিফ’-গুলি দেখি আমরা, তার সঙ্গে পরিপূর্ণ সাযুজ্য রয়েছে মধুবনী-চিত্রের রূপবিন্যাস পদ্ধতির। সেই রূপবিন্যাসের সারল্যময় একটি বিশেষ ছন্দ আছে। সেই ছন্দ লৌকিক জীবনের দৈনন্দিনতা থেকে উঠে আসা। আর এর ভিতর যে পৌরাণিক আখ্যান বা চরিত্র থাকে, সেগুলি সুদূর অতীত থেকে প্রবাহিত হতে হতে আজকের দিনে এসে পৌঁছেছে। চিত্রের সেই রূপকল্প যখন বস্ত্রে এল এবং সেই বস্ত্র যখন নাগরিক জীবনে পরিব্যাপ্ত হল, তখন অতীত বর্তমান, লৌকিক নাগরিক, পৌরাণিক ও সাম্প্রতিক এই দুই বিপরীত প্রান্তের মধ্যে ঐক্যবন্ধন ঘটল। এই ঐক্যবন্ধনই শিল্পিত সৌন্দর্যের প্রধান কাজ। শিল্প এ ভাবেই জীবনকে নন্দিত করে।
এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রদেশের শাড়ির বিচিত্র সম্ভার। বাংলার তাঁত, ধ্রুপদী কাঞ্জিভরম, রুক্মিণী দেবী উদ্ভাবিত কলাক্ষেত্র কাঞ্জিভরম, অন্ধ্রপ্রদেশের ‘টেম্পল সিল্ক’ তেলিয়া ইকত, অসম, কেরল, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে তৈরি বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। এর সম্ভ্রান্ততা বা আভিজাত্যের প্রধান উৎস অলঙ্করণ বা কারুকাজ। এই অলঙ্করণে যে বৈচিত্রময় অজস্র ‘মোটিফ’ আমরা দেখতে পাই তাতে যে শৈল্পিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন, সেখানে প্রকৃতি যে ভাবে বিমূর্তায়িত হয়েছে, এক কথায় তা অনন্য। ললিতকলা পরোক্ষ ভাবে এই অলঙ্করণের কাছে ঋণী। বিশেষত বিমূর্ত চিত্রকলা। প্রকৃতি, জীবন ও শিল্পের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলেছে এখানেও। আধুনিক শহুরে পোশাকের উপর আধুনিক বা উত্তর আধুনিক নাগরিক চিত্রকলার অভিক্ষেপের আর একটি দৃষ্টান্ত টি-শার্ট। টি-শার্টের উপর অনেক শিল্পী ছবি এঁকেছেন, রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী লিখেছেন বা উত্তর-আধুনিক ধরনে আধুনিকতার পথিকৃৎ শিল্পীদের নামও লিখেছেন কেউ। যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, সমীর আইচ, অশোক মল্লিক, চন্দ্রিমা রায় প্রমুখ শিল্পীর ছবি এ ভাবেই জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। এ সব ছাড়াও এই আয়োজনে প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয় আদিম ও উপজাতীয় মানুষের তৈরি মুখোশ এবং ধাতু ও কাঠের তৈরি নানা ধরনের ভাস্কর্য। অনেক মুখোশই হয়তো সম্প্রতি কালে তৈরি। কিন্তু এর রূপের ভিতর অভিব্যক্তির যে প্রাখর্য, সেটা প্রবাহিত হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। মগ্নচেতনার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে থাকে এখানে। ঢোকরা ভাস্কর্য সহ নানা ধরনের লৌকিক ভাস্কর্যে সংক্ষুব্ধ অভিব্যক্তিময়তা যেমন থাকে, তেমনি রয়েছে পৌরাণিক নানা চরিত্র ও আখ্যান। কালপর্বের কোনও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে এরা আবদ্ধ থাকে না। জীবন ও সৌন্দর্য চিরন্তনতায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.