হাতের কাছে ডাক্তার মেলে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালও অনেক দূরে। হাজারো ঝক্কি-ঝামেলা সামলে যখন হাসপাতালে পৌঁছনো গেল, তত ক্ষণে গ্রামের রোগীটির অবস্থা কাহিল। এটাই বাংলার অসংখ্য গ্রামের স্বাস্থ্য-বারোমাস্যা। অবশেষে গ্রামবাসীদের এই চিকিৎসা-সমস্যার কিছুটা সুরাহা হতে চলেছে। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই এ বার রোগীর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বেন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা।
সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকাংশই হবেন রোগীর কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা। ডায়মন্ড হারবার থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরের হাসিমনগরের শুভরাজ সাঁতরা; বীরভূমের বাসাপাড়া গ্রামের সরিফা খাতুন, আয়েশা সুলতান, মিতা চৌধুরী; নদিয়ার চাকদহ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের ঘুগিয়া গ্রামের শুভজিৎ বাইন, মোনালিসা শীলের মতো তরুণ-তরুণীদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প চালু করেছে শ্রমজীবী হাসপাতাল। ইতিমধ্যেই প্রথম দফার প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে।
প্রকল্পটির নাম ‘চলো যাই রোগীর বাড়ি’। যেখানে ডাক্তার নেই অথবা ডাক্তার দেখানোর জন্য রোগীকে নিয়ে যেতে হয় মাইলের পর মাইল, বিশেষ করে সেই সব অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের ছেলেমেয়েদের এই প্রকল্পে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে শ্রমজীবী হাসপাতাল। ওই সব প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামের অসুস্থ বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়াবেন। রোগীকে হাসপাতালে বা কাছাকাছি এলাকার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, নাকি বাড়িতে রেখে সাধারণ কয়েকটি ব্যবস্থা নিলে সহজেই সুস্থ করা যাবে, সেটা ঠিক করবেন তাঁরাই। |
সেবা-প্রশিক্ষণ চলছে শ্রমজীবী হাসপাতালে। হুগলির বেলুমিল্কি গ্রামে।—নিজস্ব চিত্র |
এই উদ্যোগ কেন?
শ্রমজীবী হাসপাতালের সম্পাদক অনিল সাহা বলেন, “প্রাথমিক চিকিৎসার এমন কিছু বিষয় আছে, যা গ্রাম স্তরে পাওয়া গেলে বহু মানুষকে হাসপাতালেই আসতে হয় না।” তিনি জানান, প্রত্যন্ত গ্রামেও রোগীর বাড়িতে পৌঁছে যাবেন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রাথমিক পরিষেবা তাঁরাই দেবেন। পরবর্তী পর্যায়ে চিকিৎসার কী ব্যবস্থা করা দরকার, সেই সিদ্ধান্তও নেবেন তাঁরা।
ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় জানান, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের অভিজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসকেরা হাতে-কলমে গ্রামের যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের যথার্থ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে গড়ে তুলবেন। সাধারণ ছোটখাটো অসুখ তো বটেই, প্রয়োজনে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা-পরবর্তী উপশমের ব্যবস্থাও করবেন ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা।
কী কী কাজ করবেন ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা?
স্যালাইন দেবেন। রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা মাপবেন। ইঞ্জেকশন দেবেন। অস্ত্রোপচারের পরে ক্ষতস্থান ‘ড্রেসিং’ করবেন। ওঁদের ক্যাথিটার লাগানো থেকে শুরু করে নেবুলাইজার দেওয়া, ইসিজি করার প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন শ্রমজীবী হাসপাতালের তরফে ফণিগোপাল ভট্টাচার্য। প্রশিক্ষণের শেষে প্রত্যেককে কিছু চিকিৎসা সরঞ্জামও দেওয়া হবে।
আট দিনের এই প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেওয়ার কথা ছিল মোট ২০ জনের। কিন্তু যোগ দিয়েছেন ৩৫ জন। আট দিন পরে তাঁরা গ্রামে ফিরে যাবেন এবং মাসখানেক পরে আবার আসবেন। সেই সময় ওঁদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার কথা শুনে ফের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এই ভাবে প্রতি মাসে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান অনিলবাবু। এই প্রশিক্ষণ ধারাবাহিক ভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে এই রাজ্যে ১২০টি ‘গ্রামীণ শ্রমজীবী হাসপাতাল’ গড়ে তোলা সম্ভব বলে অনিলবাবুরা আশা করছেন। |