পুস্তক পরিচয় ১...
প্রতিবাদ করে, তবু হেরে যায়
দ্য ড্রিম অব দ্য কেল্ট, মারিও বার্গাস জোসা। ফেবার অ্যান্ড ফেবার, ৪৯৯.০০
পাঠককে চমকে দেওয়ার স্বভাবটা ছাড়তে পারেননি মারিও বার্গাস জোসা (Mario Vargas Llosa)। প্রায় চারশো পাতার বইটি শেষ করার পর থতমত খেতেই হয়। এ কি জীবনী? ইতিহাস? নাকি, উপনিবেশের আশা-হতাশা, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে চমকপ্রদ এক উপন্যাস?
থতমত খাওয়া নিরর্থক। বার্গাস জোসা রয়েছেন বার্গাস জোসাতেই। তাঁর মানপত্রে নোবেল কমিটি লিখেছিল, ‘ক্ষমতায় মত্ত দুনিয়াতেও ব্যক্তি যে ভাবে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ করে, তবু হেরে যায়’ তার বয়ানই ফুটে ওঠে বার্গাস জোসার লেখায়। সেই বছরেই (২০১০) স্প্যানিশ ভাষায় বেরিয়েছিল বইটি। এতদিনে তার ইংরেজি অনুবাদ হল।
আয়ারল্যান্ডের সন্তান রজার কেসমেন্ট ইতিহাসে আজও উজ্জ্বল। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ইংল্যান্ডে আত্মীয়দের কাছে মানুষ। তরুণ বয়সে ভেসে পড়লেন কঙ্গোর দিকে। সে দেশের আদিম জনজাতিকে তিনি সভ্যতার আলোয় আনতে চান। কিন্তু কঙ্গোয় গিয়ে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। বেলজিয়ানরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করেছে। বন্দুকের জোরে জমি দখল করে জনজাতীয়দের দিয়ে রাবার চাষ করানো হচ্ছে। ১৯০৩-এ ব্রিটিশ কনসাল রজার কেসমেন্ট তাঁর রিপোর্ট দাখিল করেন। সারা ইয়োরোপে তুমুল হইচই। বেলজিয়াম শেষ অবধি তাদের কঙ্গো-নীতি বদলায়।
তারপরই ব্রাজিলে কনসাল জেনারেল হিসাবে পাঠানো হল রজারকে। পাশে পেরুর পুটামায়োতে তখন জুলিও আরানার ‘পেরুভিয়ান আমাজন কোম্পানি’র রাজত্ব। রজার দেখলেন, পুলিশ, প্রশাসন সবই আরানার কেনা গোলাম। আদিবাসীদের দিয়ে জোর করে চলছে রাবার-চাষ। কোম্পানির অত্যাচারে কয়েকটি আদিম জনজাতি লুপ্তপ্রায়। রজারের রিপোর্ট বার হওয়ার পর, জনমতের দাপটে লন্ডনে কোম্পানির স্টকহোল্ডাররা নড়েচড়ে বসলেন। এই অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট’ উপাধি দিল রজারকে।
কিন্তু রজারের মাথায় তখন অন্য পোকা। তাঁর জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডও তো ব্রিটিশের অধীনে। তার গ্যালিক ভাষা, ক্যাথলিক সংস্কৃতি সবই তো অস্তমিত। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুললেন তিনি। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকা হয়ে চলে গেলেন জার্মানি। যুদ্ধবন্দি আইরিশদের নিয়ে গড়ে তুললেন ফৌজ। শত্রুর শত্রু তোমার মিত্র!
আয়ারল্যান্ড তখন উত্তাল। ঠিক হয়েছে, ইস্টারের সময় বিপ্লবীরা ডাবলিনের রাস্তায় ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণ করবেন। জার্মানরা সেই জন্য জাহাজে অস্ত্র পাঠাবে। কিন্তু জার্মান সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া এই ভাবে ব্রিটিশদের আক্রমণ করা তো আত্মহত্যা! বিপ্লবীদের বোঝাতে রজার সাবমেরিনে চেপে আয়ারল্যান্ড চলে এলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অসুস্থ শরীরে তাঁকে এক দুর্গ থেকে গ্রেফতার করল ব্রিটিশ সেনা। কয়েক মাস পর দেশদ্রোহের দায়ে ফাঁসি। পাঠকের মনে পড়তে পারে, আইরিশ জাতীয়তাবাদের এই নায়ককে নিয়ে ইয়েটসের কবিতা...
দ্য গোস্ট অব রজার কেসমেন্ট
ইজ বিটিং অন দ্য ডোর।

চেতনার দরজায় ধাক্কা মারা সেই বিদেহীকে ফের জাগিয়ে তুললেন পেরুর নোবেলজয়ী লেখক।
ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে অবশ্য জোসার এটি প্রথম উপন্যাস নয়। বছর দশেক আগে ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসক রাফায়েল ট্রুজিলোকে নিয়ে ফিস্ট অব দ্য গোট লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে ছিল থ্রিলারের চলন। ট্রুজিলো-হত্যার কয়েক ঘন্টা আগে, পরে ঘাতকদের মনোভাব, ধরা পড়ার পর তাদের বিচার ইত্যাদিই ছিল উপজীব্য। এখানে সেই থ্রিলার-প্রাধান্য নেই। বরং আয়ারল্যান্ডে কেসমেন্টের জন্ম, অকালে মায়ের মৃত্যু থেকে শুরু হয় উপন্যাস। ঠিক জীবনীর মতো!
জীবনী, কিন্তু ইতিহাস নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু। উপন্যাসে মাঝে মাঝেই এসেছেন জেলখানার শেরিফ। রজার কেসমেন্টের প্রাণদণ্ড মকুব করার জন্য বার্নার্ড শ থেকে অনেকেই সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। ব্রিটিশ সরকার শুনবে? শেরিফ জানান, তাঁর একমাত্র ছেলে যুদ্ধে মারা গিয়েছে। রজারের মতো দেশদ্রোহীকে দেখলে তাঁর ঘৃণা হয়। রজার তা হলে ভুল করল?
ঠিক-ভুলের এই দোলাচল ঐতিহাসিক বা জীবনীলেখকদের থাকে না। তাঁদের কাছে, সব কিছুর ‘পাথুরে প্রমাণ’ থাকে। কিন্তু ঔপন্যাসিক তো মানুষের সংশয়-প্রত্যয় আর আশা-হতাশার কথা বলতে চান। ‘ইতিহাস আসলে গল্প বলা। কিন্তু নিজেকে সে মনে করে বিজ্ঞান,’ জেলখানায় বসে ভেবেছে রজার।
ইতিহাসের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধেই যেন মেতেছে জোসার নতুন উপন্যাস। ইতিহাস জানে, বিচারের সময় স্যার রজারের একটি ডায়েরি প্রকাশ পায়। ‘ব্ল্যাক ডায়েরি’ নামে খ্যাত সেই রোজনামচার পাতায় পাতায় রজারের সমকামিতার বিবরণ। এটি তাঁরই লেখা, না ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের বানানো, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা বহু দিন একমত হতে পারেননি।
জোসার উপন্যাস জানিয়েছে, রজার-ই ডায়েরি লিখেছে। এর কিছু ঘটনা সত্য, কিন্তু তা বলে সবটাই? রজার যা করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি, সেই অসহায়তার কথাও আছে সেখানে। মনে মনে যে সব পুরুষকে নগ্ন করে সে শরীরী খেলায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের নিয়েও ডায়েরির পাতায় অবদমিত কামনার প্রকাশ! কুহক আর বাস্তবতার এই পারস্পরিক গতায়াতই তো জীবন!
পরিশিষ্টে অবশ্য লেখক ব্রিটিশ ‘সভ্যতা’র মুখোশটি খুলে দিয়েছেন। ফাঁসির পরও ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা’র যুক্তিতে শবদেহের পায়ু পরীক্ষা করা হয়। ডাক্তার লেখেন,‘সাধারণের চেয়ে ফোলা। বিকৃতগামিতার প্রমাণ।’
শুধু সমকামিতার প্রশ্নে নয়, দ্বন্দ্ব সভ্যতার প্রতি স্তরে। উগ্র দেশপ্রেম কি রজারকে ভুলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? উপন্যাসে বার্নার্ড শ আড্ডায় বলেন, ‘দেশপ্রেমও ধর্মের মতো। বিশ্বাসের ব্যাপার, জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।’ জোসেফ প্লুঙ্কেটকে রজার বোঝায়, জার্মানদের সাহায্য ছাড়া ডাবলিনের রাস্তায় ব্রিটিশ সৈন্যের মোকাবিলা আত্মহত্যার শামিল। ক্যাথলিক কবির উত্তর, ‘অস্ত্র এবং সৈন্য ছাড়াও যুদ্ধে জিততে আর একটা জিনিস লাগে, রজার। ভাববাদী ঈশ্বরচেতনা। ওটা আমাদের আছে, ব্রিটিশদের নেই।’ পড়ে চমকে যেতে হয়। এই বাংলাতেও অনেক তরুণ গীতা পড়ে, কালীর পায়ে জবাফুল দিয়ে বোমা ছুঁড়তেন। চেতনার ধোঁয়াশা সর্বত্র এক রকম?
জোসার অন্য নায়কদের মতো রজার চেষ্টা করেছে এবং হেরেছে। জার্মান বন্দিশিবিরে সে আইরিশ যুদ্ধবন্দিদের কাছে যায়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তৈরি করতে হবে সেনাদল। মাত্র ৫২ জন তার দিকে আসে, অন্যরা ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে থুতু ছেটায়। যে জার্মানদের বিরুদ্ধে গতকালও তারা লড়েছে, আজ তাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ-শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ? যুদ্ধবন্দি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তাদের বাড়িতে ভাতা পাঠায়। রজারের দলে নাম লেখালে ব্রিটেন দেবে সেই ভাতা? অনাহারে মারা যাবে না তো তাদের স্ত্রী-পরিবার? ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য জার্মানির কাছে সাহায্য চাওয়া, সাবমেরিনে আয়ারল্যান্ড... লাতিন আমেরিকার এই উপন্যাস যেন আমাদেরও সরকারি ইতিহাসের বাইরে এক বিকল্প সম্ভাবনার কথা বলে। রাসবিহারী বসু যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়তে গিয়েছিলেন, তাঁকেও কী সংখ্যাগরিষ্ঠের অবিশ্বাস আর ঘৃণার মুখোমুখি হতে হয়েছিল?
শুধু বিকল্প ইতিহাসের আয়না? হ্যাঁচকা টানে আমাদের ভেতরটাকে উপড়ে এনেছেন লেখক। ‘শহিদ এবং বীর নায়কদের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা নেই, মিস্টার কেসমেন্ট। সত্য, ন্যায় ইত্যাদি কারণে যারা নিজেদের উৎসর্গ করে, তারা আসলে কিছু বদলাতে পারে না। উল্টে কারণটার ক্ষতি করে বসে’, উপন্যাসে রজারকে বলেন পুটামায়ো শহরের মেয়র।
সাধে বাঙালি পাঠক লাতিন আমেরিকান উপন্যাসের ভক্ত হয়!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.