আদালতে আসামিদের দাঁড়ানোর লোহার খাঁচার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সি ছেলেটির চোখে পলক পড়ছে না। সেই চোখের জ্বলন্ত চাউনি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, তার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন পোড়খাওয়া আইনজীবীরাও। সেই চোখের উপরেই সটান চোখ রেখে সামনে এগিয়ে গেলেন তরুণীটি। তাঁর দু’চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ঘৃণা। খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলেন আসামির দিকে। তরুণীর সেই দৃষ্টির সামনে চোখ নামিয়ে নিল আসামি। আলতো ঝুঁকে গেল মাথা।
এই কয়েক মুহূর্তেই বিচারক থেকে শুরু করে ভরা আদালত চিনে নিল বারাসতে রাজীব দাসের হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত মিঠুন দাসকে। শুক্রবার আদালতে দাঁড়িয়ে এ ভাবেই তাকে শনাক্ত করলেন রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস। লাঞ্ছনা থেকে যাঁকে বাঁচাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের মারধর ও ছুরিতে প্রাণ দিয়েছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব। |
তবে এই প্রথম নয়। বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে রিঙ্কু জানান, ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে দুষ্কৃতীদের হামলার পরে আরও এক বার অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। ওই রাতে দিদিকে সাইকেলে বসিয়ে বাড়ি ফিরছিল রাজীব। বারাসতের অফিসপাড়ায় দুষ্কৃতীরা তাদের সাইকেল থামিয়ে রিঙ্কুকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। তাঁর গায়ে মদ ঢালতে যায়। রাজীব বাধা দিতে গেলে দুষ্কৃতীরা তাকে পেটায় এবং ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ভাইকে বাঁচানোর জন্য তিনি কাকুতি-মিনতি করলেও এলাকায় জেলা কর্তাদের বাংলোর প্রহরী পুলিশও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। পরের দিন রাজীব মারা যায়। সেই হত্যাকাণ্ডের ‘প্রমাণ’-সহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার পরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে ‘টি আই প্যারেড’ বা শনাক্তকরণ প্যারেডে তাদের শনাক্ত করতে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের মধ্যে মিঠুনকে দেখে সে-দিন তার গালে চড় মেরেছিলেন তিনি। কেঁদে ফেলে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, “স্যার, এই ছেলেটিই আমার ভাইকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে।”
শুক্রবার ছিল এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দ্বিতীয় দিন। এ দিন ছিল শনাক্তকরণ ও সওয়াল-জবাব পর্ব। বারাসত আদালতের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সুদীপ নিয়োগীর এজলাসে উঠেই এই মামলায় সরকার পক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি শান্তময় বসুর প্রশ্নের উত্তরে রিঙ্কু জানিয়ে দেন, অপরাধীদের দেখলেই তিনি চিনতে পারবেন। এর পরে সারা আদালত ঘুরে তাঁর দৃষ্টি থমকে যায় লক-আপের ভিতরে। জানিয়ে দেন, সেখানেই রয়েছে তিন অভিযুক্ত। সে-রাতে কার হাতে রিভলভার ছিল, কে তাঁর গায়ে মদ ঢালতে গিয়েছিল তা-ও জানান রিঙ্কু।
মামলা চলাকালীন রিঙ্কু এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কৌঁসুলির নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে। তা নিয়ে আদালতে উপস্থিত সিআইডি-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বারাসতের এসডিপিও সুবীর চট্টোপাধ্যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সিআইডি ও পুলিশের সমন্বয়ের ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে থেকে উদ্ধার হওয়া রিভলভার থেকে শুরু করে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এ দিন আদালতে বিচারকের কাছে তুলে ধরে সিআইডি। সে-দিন যে সাইকেলে ভাইবোনে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছিলেন, সেটিও দেখানো হয় আদালতে। একটি নীল জিনস দেখে জলে চোখ ভরে যায় রিঙ্কুর। প্যান্টটিকে বুকের কাছে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, ভাই সে-দিন এই জিনসটাই পরেছিল।” “এটাই কি সেই ছুরি?”
বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে একটি স্প্রিং-ছুরি হাতে নেন রিঙ্কু। পরম যত্নে ছুরিতে লেগে থাকা রক্তে আলতো হাত বোলান। সিআইডি-র দাবি, রাজীবকে মারতে দুষ্কৃতীরা ওই ছুরিটাই ব্যবহার করেছিল। ছুরিতে লেগে থাকা রক্তের সঙ্গে রাজীবের রক্তের মিলও পাওয়া গিয়েছে পরীক্ষায়। ছুরিটি সরকারি কৌঁসুলির হাতে ফিরিয়ে দেন রিঙ্কু। বলেন, “হ্যাঁ। এটাই।” |