নবম শ্রেণির পর একটি ‘ছোট মাধ্যমিক’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করিবার যে পরিকল্পনা ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা খারিজ করিয়া দিয়াছেন। তিনি কারণ দেখাইয়াছেন, ইহাতে ছাত্রছাত্রীদের উপর চাপ বাড়িবে। যুক্তিটি অসঙ্গত নহে। কিন্তু তাঁহার এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে আরও শক্তিশালী এবং মৌলিক যুক্তি আছে। ছাত্রছাত্রীরা কতটা শিখিল, ইহা বুঝিতে পারাই যদি পরীক্ষার প্রধান প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে তাহাদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন কেন তাহার উপযুক্ত উপায় বলিয়া ধরা হইবে না? বাহিরের কোনও একটি বিশালায়তন ব্যবস্থা, যাহা একত্রে কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মূল্যায়ন করিবে, তাহার প্রয়োজন কী? কেহ বলিতে পারেন, সব স্কুলের মান সমান নহে, সকলের মূল্যায়ন পদ্ধতিও সমান না হইতে পারে। তাই কোনও একটি পরীক্ষায় কাহার অবস্থান কোথায় তাহা নির্ণয়ের প্রয়োজন রহিয়াছে। এই যুক্তি অসার নহে, কিন্তু প্রশ্ন হইল, সেই প্রয়োজন কাহার? প্রয়োজন কী জন্য? কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য, অথবা কাজের দরখাস্তের জন্য সেই প্রয়োজন হইবে। তাহা হইলে একটির অধিক পরীক্ষায় এমন মূল্যায়নের প্রয়োজন কী? আন্তঃরাজ্য পরীক্ষার সংখ্যা অকারণে না বাড়াইয়া বরং কমাইবার দিকেই যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। এখন এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি বৃহৎ আন্তঃরাজ্য পরীক্ষা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন কিন্তু ইতিমধ্যেই দশম শ্রেণির পর্ষদ পরীক্ষাকে ঐচ্ছিক করিয়া দিয়াছে। যাহারা অন্য বোর্ডে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়িতে চাহে, কেবল তাহাদের জন্যই দশম শ্রেণিতে একটি পর্ষদ-পরিচালিত পরীক্ষা নেওয়া হইয়া থাকে। অপর সকল ছাত্র তাহাদের জীবনের প্রথম পর্ষদ-পরিচালিত পরীক্ষাটিতে দ্বাদশ শ্রেণির পরেই বসিয়া থাকে। এই ব্যবস্থাটি পশ্চিমবঙ্গের জন্যও সুপ্রযুক্ত হইবে না কেন, তাহা চিন্তা করিবার প্রয়োজন আছে।
শিক্ষাকে যে ছাত্রদের নিকট ভীতিপ্রদ করিয়া না রাখিয়া আকর্ষণীয় করিতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রীর এই চিন্তার মধ্যে যথেষ্ট সারবত্তা রহিয়াছে। রাজ্যের শিক্ষা চিত্রও সেই উদ্দেশ্যেই নীতি রচনার ইঙ্গিত দিতেছে। এ রাজ্যে এই বৎসর সাড়ে দশ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়াছিলেন। কিন্তু দশ বৎসর পূর্বে ২০০২ সালে স্কুলে নাম লিখাইয়াছিলেন অন্তত ১৮ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। ইহার অর্থ, সাত লক্ষেরও অধিক ছাত্রছাত্রী স্কুল শেষ করিতে পারিতেছে না। ইহাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করা শিক্ষানীতির প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হইতে হইবে। কিন্তু তাহা শিক্ষার মানের অবমূল্যায়নের দ্বারা নহে, কারণ তাহা হইলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আমরা ছাত্রদের হারাইব। এই বৎসর মাত্র সাড়ে পাঁচ লক্ষ ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতকার্য হইয়াছে। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চ আয়ের সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইতেছে। মানবসম্পদের এই অপচয় রোধ করিবার কাজে পর্ষদের পরীক্ষার জটিল উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর? পর্ষদের পরীক্ষাগুলিকে কেন্দ্র করিয়া যে বিপুল পরিমাণ সময় ও সম্পদ ব্যয়িত হয়, তাহা শিক্ষার প্রসারে বা মান উন্নয়নে কতটা কাজে লাগে? মাধ্যমিক পরীক্ষা-সর্বস্ব শিক্ষানীতি না রাখিয়া স্কুলগুলির নিয়মিত কার্যকারিতার প্রতি, নিয়মানুবর্তিতা ও মূল্যায়নের পদ্ধতির প্রতি নজর দিলে ছাত্ররা কি অধিক উপকৃত হইবে না? এই প্রশ্নগুলি এ বার চিন্তা করা প্রয়োজন। |