|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
‘চিত্রাঙ্গদা’য় গবেষণা ছাড়া কি আত্মজীবনীও আছে |
খুব সাহসী নির্মাণ। সঙ্গে অঞ্জন দত্তের শ্রেষ্ঠ অভিনয়।
লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
ঋতুপর্ণ ঘোষ ওঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবি দিয়ে বাংলা সিনেমায় প্রায় একটা অসাধ্য সাধন করে বসেছেন । একটা ডিসকোর্স পেশ করেছেন। কাহিনির বন্ধনে একটা যুক্তি-তক্কো-গপ্পের আসর, যা ক্রমাগত প্রসঙ্গ তুলে আনে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত জনপ্রিয়তম নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’-র। ছবির নায়ক রুদ্রর সমস্যা সে সারাজীবন পুরুষদেহে এক নারীর সত্তা বহন করে চলেছে। কবির সার্ধশতবর্ষে ‘চিত্রাঙ্গদা’ বহন করতে গিয়ে, সেখানে মদনের ভূমিকায় নেমে, সে ক্রমাগত অনুভব করছে যে ওর পুরুষ জীবন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, ওর সত্তায় নারীত্বের প্রবল সংক্রমণ ঘটেছে। যা কোনও রোগ নয়, এক বহতা মনোবেদনা, এক আত্মবিশ্বাসের আকাঙ্ক্ষা। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা যুবক মনে করছে পড়াশুনা শেষ করে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষা করা গেছে, কিন্তু চিন্তায় পড়েছে নিজের মধ্যে লুকোনো মানবীর জন্য। দৈববলে কুরূপা থেকে সুরূপা হয়ে ওঠা চিত্রাঙ্গদা ওর মনের এই দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে আরও তীব্র, তীক্ষ্ন করে তুলছে। নৃত্যনাট্য ওর মায়াদর্পণ হয়েছে। যখন ওর জীবননাট্যে প্রবেশ মাদকাসক্ত ড্রামবাদক পার্থর। অচিরে ওদের একটা সমকামী সম্পর্ক হয়ে ওঠে, চিত্রাঙ্গদার জীবনে অর্জুনের মতো রুদ্রর জীবনেও নির্বিকল্প হয়ে ওঠে পার্থ (অর্জুনের আরেক নাম)।
পার্থর বেপরোয়া পুরুষালি দখলদারি রুদ্রর নারীত্ব উপভোগ ও প্রকাশের মাত্রাকে প্রায় চরমে নিয়ে তোলে, পরিচালক ও রুদ্রর ভূমিকায় অবতীর্ণ ঋতুপর্ণ ছবির এই পর্বটাকে নানা নাটকীয়তা ও ডিটেলে গড়েছেন। এই পর্ব ও ছবির এক শীর্ষ মুহূূর্তে এসে পড়ে যখন রুদ্র ও পার্থ একটি সন্তান দত্তক নিতে মনস্থ করে এবং আবিষ্কার করে যে, দু’জন পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সংসারী হলেও তাদের পক্ষে দত্তক নেওয়ায় আইনের বাধা আছে। দত্তক গ্রাহক দম্পতির একজনকে অন্তত নারী হতে হবে।
ব্যঙ্গের সঙ্গে এ সময়ে এক সংলাপে বলাও হয়েছে, এ তো এল্টন জনের দেশ নয় যে ‘গে কাপল’ আইনত বাবা-মাও হতে পারে। |
|
চিত্রাঙ্গদা দ্য ক্রাউনিং উইশ
ঋতুপর্ণ, যিশু, অঞ্জন, রাইমা, দীপঙ্কর |
এইখানেই এক নাটকীয় মোড় বলা যায় রুদ্রর জীবনে। পার্থকে জীবনে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে ও লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাতে নারীত্বের সম্পূর্ণ এবং দত্তক নিয়ে মাতৃত্বকে সম্ভব করা যাবে। পার্থর সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ও শরীরী মিলনের সম্পর্কয় সিলমোহর সাঁটা যাবে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র সমতুল মুহূর্ত যদি সনাক্ত করতে হয় তো উদ্ধৃত করতে হবে সেই দৃশ্য যেখানে অর্জুন বলছেন কুরূপা চিত্রাঙ্গদাকে— ‘ক্ষমা করো আমায়,/বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে, ব্রক্ষ্মচারী ব্রতধারী’। যে প্রত্যাখ্যানে চিত্রাঙ্গদা কান্নায় গেয়ে উঠেছে ‘রোদন-ভরা এ বসন্ত/কখনো আসেনি বুঝি আগে’। ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অবিশ্যি এই প্রত্যাখ্যান আসে অনেক পরে, যখন শারীরিক ভাবে রুদ্রর নারী হয়ে ওঠার উদ্যোগ-অস্ত্রপচারকে মেনে নিতে পারে না পার্থ। রুদ্রর শরীরে সার্জারিতে ওর গোড়া থেকেই আপত্তি ছিল, ও লিঙ্গান্তরিত হতে সেই বিতৃষ্ণা চরমে পৌছল। রুদ্রকে দেখতে হাসপাতালে গেল যখন ও, তত দিনে নাট্যদলের সুন্দরী নায়িকা কস্তুরীর সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে!
রুদ্র-পার্থর বিচ্ছেদ রবিঠাকুরের স্ক্রিপ্ট মেনে নয়, জীবনের স্বভাব ও নিয়মে। অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার মতো রুদ্র-পার্থর মিলন হয় না। রুদ্র ফিরে আসে বাবা-মায়ের সংসারে। যেখানে একদিন বজ্রপাত ঘটিয়ে ও ঘোষণা করেছিল অস্ত্রোপচার করিয়ে মেয়ে হবে! প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানের থেকে এও কিন্তু কম ট্র্যাজিক মুহূর্ত নয়।
ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’র আগের-পরের সব সময়কেই ধরা-ছাড়া হয়েছে। হাসপাতালে রুদ্রর অপারেশন, তার প্রস্তুতি ইত্যাদি দেখাতে দেখাতে। অপারেশন একই সঙ্গে ওঁর ইচ্ছাপূরণ ও বিপর্যয়কে সম্পূর্ণ করবে। হাসপাতালের সময়গুলোকে বেশ ভিন্ন ট্রিটমেন্টে বেঁধেছেন ঋতুপর্ণ এক মনোবিদকে রুদ্রর সামনে বসিয়ে। ওদের আলাপচারিতাতেই রুদ্রর ভেতরের ভাবনা, অবদমিত বাসনা সব সংলাপ হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। ক্রমে আমরা টের পেতে শুরু করি এ সবই রুদ্রর নিজের মনের সঙ্গে বিতর্ক। মনোবিদ শুভ কোথাও নেই।
‘চিত্রাঙ্গদা- দ্য ক্রাউনিং উইশ’ খুবই নতুন ধরনের, সাহসী কাজ। লিঙ্গ সমস্যা নিয়ে কাজ বলেই হয়তো ছবির তাবৎ সংলাপের এক তৃতীয়াংশ ইংরেজিতে। বিখ্যাত নৃত্যনাট্যের লিঙ্গ রূপান্তরের সঙ্গে এই সময়ের পরিস্থিতিকে বাঁধতে একটা কার্যকর কাহিনিও উদ্ভাবন করেছেন ঋতুপর্ণ। পরিচালক-কাহিনিকার যেহেতু তাঁর লিঙ্গ সত্তা ও নির্বাচন নিয়ে কোনও আড়াল রাখেননি কখনও, তাই জানতে ইচ্ছে করে ‘চিত্রাঙ্গদা’য় গবেষণা ছাড়াও অনেকটা আত্মজীবনীও কি আছে? জানি না অবশ্যি কোনও কোনও চলচ্চিত্রকারকে এমন প্রশ্ন করা উচিত হয় কি না।
তবুও যে প্রশ্নটা করলাম তার কারণ ‘চিত্রাঙ্গদা’র তর্ক ও ডিসকোর্স যতটা আগ্রহী করে দর্শককে রুদ্র-পার্থর সম্পর্ক ততটাই উদাসীন করে দেয়। কিছুটা ছেলেখেলা, অনেকটাই প্রক্ষিপ্ত মনে হয়। সে তুলনায় বাবামায়ের সঙ্গে রুদ্রর মনের সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা খুবই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সবচেয়ে করুণ ও বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে রুদ্রর নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক। যেটা মনোবিদের সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনে প্রতিষ্ঠা করা গেছে। বিশেষ করে পার্থর প্রত্যাখ্যানের পর যে সরল যুক্তি দিয়ে (“ও তো বারণই করেছিল”) পরিস্থিতির সামাল দেয় ও। ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখে কেন জানি না ফের মনে হল সংবেদী সংলাপ ও কল্পনার প্রয়োগ ও ব্যবহারে ঋতুপর্ণ অনেক বেশি দক্ষ। সৃষ্টিশীল কাহিনি সংগঠনের চেয়ে। |
|
চিত্রাঙ্গদা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন অসাধারণ সব অভিনয়ে। সব চেয়ে আশ্চর্য করেছে অঞ্জন দত্তের মনোবিদ, সম্ভবত অদ্যাবধি ওঁর শ্রেষ্ঠ অভিনয়। প্রথমত ওঁর মেক আপটাই অসাধারণ। অঞ্জনের পূর্ণ রূপান্তর। সঙ্গে হাসি মাখানো নম্র স্বরক্ষেপ। ব্যঞ্জনাময় চাহনি। সারা ছবি জুড়ে থেকেও কেমন বায়বীয় এক উপস্থিতি। প্রায় না থাকা।
মুগ্ধ করে দিয়েছেন বাবার ভূমিকায় দীপঙ্কর দে। কোনও কথা না বলেই সব বলে যাচ্ছেন একেক সময়ে। ওঁর এবং অনসূয়া মজুমদারের মায়ের রোল ছবির সমান্তরাল ট্র্যাজেডিকে মর্মস্পর্শী ও মর্মান্তিক করেছে। যদি চোখে জল এসে থাকে দর্শকের তবে এঁদেরই পরিস্থিতি ও অভিনয়ে।
রীতিমতো পোক্ত অভিনয়ে রুদ্র ও পার্থর চরিত্রে ঋতুপর্ণ ও যিশু সেনগুপ্ত। সুদর্শন ও মাচো চেহারা যিশুর এ ছবিতে। বেশ শারীরিক অভিনয়। চোখে মুখে ধারালো অভিব্যক্তি। এবং চমৎকার টাইমিংয়ে সংলাপ। আর ঋতুপর্ণ? গোটা ছবি জুড়েই তো উনি। হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, যৌনতা, মৌনতা, তর্ক, স্মৃতি, রোমান্স সব কিছু দিয়েই ভরপুর ঋতুপর্ণের রুদ্র। খুব যত্নের সঙ্গে নিজেকে প্রয়োগ করেছেন সেই সব সংলাপ ও অভিনয়ে। অভাব শুধু— এবং এটা একটা মস্ত অভাব— লাস্যের। রুদ্রকে মনোগত ভাবে যতটা নারী করতে পেরেছেন, শরীরে ততটা নয়। ক্লোজ আপে এলেই রুদ্রকে আর তেমন যুবক মনে হয়নি। ঋতুপর্ণের বয়সটা বড় ভার হয়ে চেপেছে রুদ্রর ওপর। সুন্দরী রাইমা সেনকে খুব সুন্দরীই লেগেছে। তবে কম কাজ বলে ক্ষণিকের অতিথি মনে হল।
পরিচালনা ও অভিনয়ের পাশাপাশি ‘চিত্রাঙ্গদা’র রূপায়ণে বড় অবদান অভীক মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগী গোপী ভগতের সিনেমাটোগ্রাফি। খুব ‘ফ্লুইড’ ক্যামেরা সঞ্চালনা আগাগোড়া। যা নানা সময়ের ঘটনাবলিকে নিস্তরঙ্গ সাবলীলতায় মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। যাকে আরও নিখুঁত করেছে অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা। আর কী নৃত্যনাট্য, কী বাস্তব জীবনে সঙ্গীতের প্রয়োগ প্রায় অমোঘ। দেবজ্যোতি মিশ্রের সুরারোপে চমৎকার ঝাঁঝ ও প্যাশন এবং বর্ণময়তা। কেবল তিনটে জটিল মুহূর্তে খেয়ালের আবহ কোনও কাজে আসেনি। অনুভূতির মাত্রাবৃদ্ধি ঘটেনি। ইন্দ্রনীল ঘোষের শিল্প নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করব, বিশেষত ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের দৃশ্য ভাবনায়। ক্যামেরা, সেট ও লাইটিংয়ের তালমিলে কার্লস সাউরা-র ‘ফ্ল্যামেঙ্কো’ ব্যালে ভিত্তিক ছবির দৃশ্য মনে পড়ে যাচ্ছিল। তবে রুদ্রর ঘরকে আর একটু খামখেয়ালি, সামান্য এলোমেলো করা যেত না? |
|
|
|
|
|