সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ চালুর পক্ষে মত দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই মর্মে একটি সংবিধান সংশোধনী বিলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী কাল বিলটি রাজ্যসভায় পেশ করা হবে। বিলটি পাশ করাতে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। এখনও অবধি অবশ্য সমাজবাদী পার্টি এবং শিবসেনা ছাড়া আর কেউই প্রত্যক্ষ ভাবে বিলটির বিরোধিতা করেনি। বিজেপির নেতারা কেউ কেউ তাঁদের কিছু আপত্তির কথা জানিয়েছেন বটে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে তাঁদের দলগত অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়।
মন্ত্রিসভার এই অনুমোদনে স্বভাবতই সবচেয়ে খুশি মায়াবতী। উত্তরপ্রদেশে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বে তিনি সরকারি চাকরির পদোন্নতিতে সংরক্ষণ কোটা চালু করেছিলেন। রাজস্থানেও অনুরূপ পদক্ষেপ ঘোষিত হয়েছিল। এ বছর এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট ওই দুই রাজ্যের সংরক্ষণকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। তার পরই সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্র বিভিন্ন দল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। সংবিধান সংশোধনী বিলের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। এ নিয়ে একটি সর্বদল বৈঠক আগেই করেছিল সরকার। মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র পেয়ে কেন্দ্র এ বার সংসদে বিল পাশ করানোর জন্য ঝাঁপাবে।
মায়াবতী সরকারের সংরক্ষণ নীতির বিরোধিতা কেন করেছিল সুপ্রিম কোর্ট? শীর্ষ আদালতের বক্তব্য ছিল, প্রথমত এই সংরক্ষণ সংবিধানের মৌলিক নীতির বিরোধী। দ্বিতীয়ত, সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রতিনিধিত্বের অভাব সত্যিই কতটা, তার পরিসংখ্যান নেই। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করতে হলে তিনটি দিক যথাযথ ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এক) তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তদের অনগ্রসরতা, দুই) তাঁদের প্রতিনিধিত্বের অভাব এবং তিন) সামগ্রিক প্রশাসনিক দক্ষতা।
নতুন বিল কী করতে চাইছে? সংবিধানের ১৬ (৪) ধারা সংশোধন করে ‘অপর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বে’র শর্তটিই বাদ দিতে চাইছে সরকার। সে ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বের অভাব প্রমাণ করার দায় আর থাকবে না। তার বদলে ১৬ (৪ ক) ধারা এনে বলা হচ্ছে, “সংবিধানের আর যেখানে যা-ই বলা হয়ে থাক না কেন, সংবিধানের ৩৪১ এবং ৩৪২ ধারায় নথিভুক্ত তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের অনগ্রসর বলে গণ্য করা হবে। এই ১৬ এবং ৩৩৫ ধারার কোনও কিছুই সরকারি চাকরির পদোন্নতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।” বিলটি পাশ হলে ১৯৯৫ সালের ১৭ জুন তারিখ থেকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পদোন্নতিতে সংরক্ষণ কার্যকর করা হবে।
সংসদের বাদল অধিবেশনের মেয়াদ এই সপ্তাহটুকুই। তার মধ্যে গত দশ দিন যাবৎ কয়লা কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবিতে সংসদ অচল করে রেখেছে বিজেপি। ঠিক এই সময় সংরক্ষণ তাসটি খেলে কংগ্রেসও একটা মোক্ষম চাল দিল বলে মনে করা হচ্ছে। সমাজবাদী পার্টির তরফে আজ খোলাখুলি এটাকে ‘নজর ঘোরানোর রাজনীতি’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু চলতি অধিবেশনেই বিলটি যাতে পাশ হয়ে যায়, তার জন্য কোমর বেঁধেছেন মায়াবতী। আজ তিনি নিজে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিজেপির দলনেতা সুষমা স্বরাজ এবং অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করেছেন। বিলটির জন্য তাঁদের সমর্থন চেয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, “বিজেপি এবং তার বন্ধুরা যদি আমাদের আবেদনে সাড়া না দেয় এবং ইউপিএ যদি বিলটি পাশ না করায়, তা হলে আমরা একটা কথাই ধরে নেব। ধরে নেব যে, ওরা কেউই চায় না তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াক!” মায়ার আশা, বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্কের কিছু নেই। “সংসদে এক ঘণ্টার মধ্যেই বিলটি পাশ হয়ে যাওয়া উচিত।”
মায়ার এই চ্যালেঞ্জকে একেবারে অগ্রাহ্য করা দলগুলির পক্ষে সহজ হবে না বলেই রাজনীতিবিদদের ধারণা। কারণ বিষয়টির সঙ্গে ভোটব্যাঙ্কের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যদিও কংগ্রেসের একাংশের আশঙ্কা, এই বিল মধ্যবিত্তদের অখুশি করবে। সমাজবাদী পার্টি বিলটির বিরোধিতা করেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের আপত্তি সংরক্ষণের বিরুদ্ধে নয়। মুলায়মের দলের বরং বক্তব্য, পদোন্নতিতে সংরক্ষণের সুযোগ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) জন্যও থাকা উচিত। নইলে তা সংবিধানের পরিপন্থী হবে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ সপা-র উদ্দেশে বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে ওবিসিদের জন্যও সংরক্ষণ চালু করা হবে। তাঁর দাবি, “এটা রাজনৈতিক গুগলি নয়, সত্যিকার সৎ প্রয়াস।” মায়াবতীর বক্তব্য, ওবিসি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যও যদি সংরক্ষণ থাকে, তাকে সর্বাগ্রে স্বাগত জানাবে বিএসপি।
চলতি অধিবেশনে বিল পাশ হবে? অনেকেই সন্দিহান। সংবিধান সংশোধনী বিলে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। সুতরাং বিরোধীদের বাদ দিয়ে এগোতে পারবে না সরকার। বিজেপি আজ রাতে জানায়, তারা নীতিগত ভাবে বিলটির বিপক্ষে নয়। কিন্তু কয়লার মতো বিষয় থেকে চোখ সরানো চলবে না। কয়লা বিতর্কের ফয়সালা হওয়ার পরে সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। মুলায়মরা এমনিতেই কাল সংসদে ঝড় তুলবেন। মুলায়ম বলেও রেখেছেন, বিল যদি সংসদে পাশ হয়েও যায়, শেষমেশ সেটা সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যাবে। আশঙ্কাটা কংগ্রেসেরও নেই, তা নয়। সলমন খুরশিদ অবশ্য দাবি করছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল জি ই বাহানবতীর পরামর্শ নিয়েই খসড়া করা হয়েছে। |