বিভিন্ন রাজ্যের অপরাধ-তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের পাশাপাশি ঘটনার ‘প্রেক্ষিত’ বিচারের দাবি পশ্চিমবঙ্গ তুললেও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) তা মানতে নারাজ। এ বিষয়ে রাজ্যের পাঠানো প্রস্তাবের জবাবে এনসিআরবি পাল্টা চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, বছরশেষে তাদের প্রকাশিত অপরাধ-তথ্যপঞ্জিতে শুধু পরিসংখ্যানই থাকবে, তবে রাজ্য চাইলে নিজের মতো করে পুস্তিকা বানাতে পারে। সেই মতো রাজ্য সরকার ‘পশ্চিমবঙ্গে অপরাধ’ (ক্রাইম ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল) শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে বলে সরকারি-সূত্রের খবর।
দিন কয়েক আগে এনসিআরবি দেশের অপরাধ সংক্রান্ত তথ্যপঞ্জি (ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া) প্রকাশ করতেই রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসেছিল। তথ্যপঞ্জি মোতাবেক, ২০১১-য় মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের শীর্ষে (মামলার সংখ্যা ২৯১৩৩)। তার পরে আছে যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র ও রাজস্থান।
মহাকরণ-সূত্রের খবর: রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন যাতে এ ভাবে তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়ার লিখিত বিরোধিতা করে, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে নির্দেশ যায়। সেই মতো এনসিআরবি-র ডিজি সফি আলমকে চিঠি লিখে পশ্চিমবঙ্গের বক্তব্য পেশ করেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রস্তাব ছিল, দেশের অপরাধ সংক্রান্ত তথ্যপঞ্জিতে পরিসংখ্যান ছাড়াও কোন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে কোন ঘটনা ঘটেছে, তারও উল্লেখ থাকুক। এ হেন প্রস্তাবের কারণ কী?
রাজ্য সরকারের যুক্তি: নিছক পরিসংখ্যান দিয়ে নারী-নিগ্রহের ঘটনাবৃদ্ধির বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের ‘সামাজিক স্বাধীনতা’ও অন্যতম কারণ বলে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন মনে করছে। তাদের বক্তব্য: অন্যান্য রাজ্যে অত্যাচারিতা মেয়েরা অনেকে থানায় যাওয়ার সাহস পান না। কিছু সময়ে সমাজও তা ভাল চোখে দেখে না। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা স্বচ্ছন্দে থানায় যেতে পারেন, পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ নথিভুক্ত করে। রাজ্যের পুলিশকর্তারা এ-ও বলছেন, এ রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো অনেক বেশি সক্রিয়। তারাও নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে।
আর এই সব কারণেই পশ্চিমবঙ্গে নারী-নিগ্রহের ঘটনার নথিভুক্তি সংখ্যায় বেশি বলে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের দাবি। যদিও এনসিআরবি’র এক মুখপাত্র বলেন, “কারণ যা-ই হোক, মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা যে পশ্চিমবঙ্গে বেশি, সেটাই আমরা পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছি।” তাঁর সাফ কথা, “আমাদের তথ্যপঞ্জিতে দেশ জুড়ে ঘটা নানা ধরনের অপরাধ এবং পুলিশি সাফল্য-ব্যর্থতার যে তথ্যনির্ভর চিত্র তুলে ধরা হয়, সেখানে প্রেক্ষিত উল্লেখের কোনও সুযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গের ডিজি-র চিঠির উত্তরে আমরা এটাই জানিয়েছি।”
তবে কেন্দ্রীয় তথ্যপঞ্জি থাকলেও রাজ্য সরকার যদি নিজের মতো করে রাজ্যের অপরাধ-তথ্য প্রকাশ করতে চায়, তাতে এনসিআরবি’র আপত্তি নেই। এ কথা রাজ্যকে তারা জানিয়েও দিয়েছে। এবং পশ্চিমবঙ্গও সেই লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিমধ্যে মহাকরণ থেকে জেলায়-জেলায় পুলিশ সুপারদের চিঠি লিখে বলা হয়েছে গত জুলাই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে। কোন ঘটনা কোন পরিস্থিতিতে ঘটেছে, পরবর্তী কালে তার তদন্তে কী ‘সাফল্য’ মিলেছে, সে সবও জেলা পুলিশের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে বলে মহাকরণ-সূত্রের খবর। তবে তথ্যগুলো কী ভাবে লিপিবদ্ধ করা হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। মহাকরণের এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “এনসিআরবি-তে যেমন তথ্য পাঠানো হয়, তেমনই হবে। তার বাইরেও আমরা আলাদা তথ্যপঞ্জি বানাব। তাতে কোন অপরাধ কোন পরিস্থিতিতে ঘটেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।”
রাজ্যের অপরাধ-চিত্র প্রকাশের ‘নিজস্ব’ উদ্যোগ অবশ্য নতুন নয়। ইতিমধ্যে কেরল, কর্নাটক, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও সর্বশেষ জম্মু-কাশ্মীর নিজের মতো করে অপরাধ সংক্রান্ত পুস্তিকা বার করেছে। তবে কেউই সেখানে অপরাধের প্রেক্ষিত উল্লেখ করেনি বলে মহাকরণের খবর।
এনসিআরবি-মুখপাত্রটি বলেন, ১৯৫৩ থেকে তাঁরা যে আদলে দেশের অপরাধ-চিত্র প্রকাশ করে আসছিলেন, ১৯৯৪ সালে তা পাল্টানো হয়। আরও কিছু পরিবর্তন দরকার কি না, তা নিয়ে ২০০৬-এ সব রাজ্যকে চিঠি দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ পর্যন্ত মাত্র যে দশটি রাজ্য সুপারিশ পেশ করেছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ নেই বলে মুখপাত্রটির দাবি। “ভ্রূণহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে সাইবার-অপরাধও। বিভিন্ন রাজ্যের মতামত মেনে ২০১৩ থেকে অপরাধের তথ্যপঞ্জিতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে।” বলেন তিনি। |