ব্রাজিলের ঝাল-মিষ্টি পাইনঅ্যাপ্ল চিংড়ি বনাম বাংলার আনারসি ইলিশ। শেষ পাতে সাহেবি পাইনঅ্যাপ্ল পুডিং-মুসের প্রতিদ্বন্দ্বী আনারসের রসগোল্লা-জিলিপি।
বিশ্বায়নের জমানায় এই টক্কর আর অসম্ভব বলা যাচ্ছে না। সাধের ফুটবলে ব্রাজিলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দুঃসাহস কবেই হারিয়ে ফেলেছে বাঙালি। কিন্তু এই অন্য ‘ম্যাচে’ হাল ছাড়তে রাজি নয়। তার প্রস্তুতি নিতেই এখন খাস সাওপাওলো পাড়ির দিন গুনছে শিলিগুড়ি। বাংলার ফুটবল-গরিমা ধূসর স্মৃতি ঠিকই। তবু আনারসের মহিমায় ব্রাজিলকে টেক্কা দেওয়ার স্বপ্ন অবাস্তব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্ব আনারস-মানচিত্রে জায়গা করে নিতে প্রাণপণ লড়ছে শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া আধা মফস্সল বিধাননগর। দেশ-বিদেশের আনারসপ্রেমীদের ডেকে এনে চমকপ্রদ সব আমিষ-নিরামিষ পদ, জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশে তাক লাগিয়ে দিতে এখানে শুরু হচ্ছে আনারস-উৎসব। সরকারি উদ্যোগে এমন প্রয়াস এই প্রথম। কাল, শনিবার থেকে তিন দিন ধরে চলবে উৎসব। এর পরেই আনারসের উৎকর্ষ বাড়ানোর কৌশল শিখে নিতে ব্রাজিল-সফরে যাবেন শিলিগুড়ির ১০ জন চাষি।
এই ‘টিম বেঙ্গল’-এর এক জন অরুণ মণ্ডলের উচ্ছ্বাস থামতেই চায় না। “শিলিগুড়ির আনারস কীসে কম! শুধু চাষের পরিকাঠামো আর একটু ভাল করতে হবে।” ৫০ বছর ধরে আনারস চাষে যুক্ত অরুণবাবুর পরিবার। শিলিগুড়ির মরশুমি আনারস ইতিমধ্যে কলকাতা জয় করেছে। ভবানীপুরের বলরামে তাজা আনারসকুচি ঠাসা সন্দেশ, ‘পাইনঅ্যাপ্ল মৌসুমি’র এই বর্ষায় জোর কদর। আনারস-উৎপাদনে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকেও বাংলার রকমারি আনারস-পদে ‘ঘায়েল’ করা সম্ভব বলে আত্মবিশ্বাসী উত্তরবঙ্গের আনারস-চাষিরা।
বাংলার চাষিদের এই সৃষ্টিকে বিশ্ব-দরবারে মেলে ধরতে এগিয়ে এসেছেন শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ)-এর চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “শিলিগুড়ি মানেই টি-ট্যুরিজম-টিম্বার ও টেবল টেনিস শুধু নয়। শিলিগুড়ির আনারসও বিশ্বমানের।” পেশায় ডাক্তার রুদ্রবাবু আনারসের উপকারিতার ঢাক-ঢোল পেটাতে অন্য ডাক্তারদেরও আসরে নামিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও উৎসাহে ফুটছেন। বাংলার সরকারি উৎসব লাগোয়া রাজ্য সিকিম, পড়শি রাষ্ট্র নেপাল, ভুটানের আনারসপ্রেমীদেরও রসস্নাত করবে বলে আশা করছেন তিনি। |
বস্তুত, এটাই দুনিয়ার আনারস-মরশুম।
হাওয়াই থেকে বাহামা। সাওপাওলো থেকে ব্যাঙ্কক। মণিপুরের ইম্ফল থেকে শিলিগুড়ির বিধাননগর। সবাইকে এক সুতোয় বাঁধছে আনারসই। বছরভর টিন-বন্দি ‘পাইনঅ্যাপ্ল’ মিললেও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের টাটকা আনারসের জাতটাই আলাদা। সময়ের ফলটা সময়ে চাখার সংস্কৃতিও ফের মনে করিয়ে দিচ্ছে শিলিগুড়ির উৎসব। টানা তিন দিন আনারস নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রতিযোগিতা, খানাপিনা, নাচগানের আয়োজন।
বাংলার আনারস চাষের ইতিহাস অবশ্য নিছকই আনকোরা নয়। সে-কালের গুণী গিন্নিরাও আনারস নিয়ে কত তুকতাক জানতেন। আনারসের মুগ ডাল, ঘরোয়া আনারস কুল্পি, আনারসের রস দিয়ে মাখা ময়দায় লুচি-পরোটার সাক্ষ্য মিলবে পুরনো রান্নার বইয়ে। কিন্তু তবু এই রসালো উৎকর্ষের মর্ম বুঝতে আমবাঙালির সময় লেগেছে। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘আনা দরে পাওয়া যায় কত আনারস।’ অর্থাৎ, আনারস যেন নেহাতই হেলাফেলার বস্তু। বিধাননগরের আনারস-কারবারিদের সংগঠনের কর্তারা এখনও এই অবহেলা নিয়ে দুঃখ করেন।
এ রাজ্যে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির বিধাননগরে আনারসের জয়যাত্রা শুরু গত শতকের ষাটের দশকে। এ তল্লাটে ভাল বৃষ্টি হয়। কিন্তু জল দাঁড়ায় না। খটখটে রোদও মেলে। সব মিলিয়ে আনারস চাষের ‘আদর্শ’ আবহাওয়া। ৫০ বিঘায় যে চাষ শুরু হয়েছিল, তা এখন প্রায় ১৪ হাজার হেক্টরে পৌঁছে গিয়েছে।
উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়িও পিছিয়ে নেই।
দুই জেলায় ছ’হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হচ্ছে। অল্প-বিস্তর চাষ হচ্ছে মালদহ, ও দক্ষিণ দিনাজপুরেও। শুধু বিধাননগরেই প্রায় ১৮ হাজার আনারস চাষি রয়েছেন। বছরে সাড়ে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন আনারস উৎপাদিত হয় শুধু বিধাননগরেই। সব মিলিয়ে ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আনারস চাষের সঙ্গে যুক্ত।
এই ‘আনারস-ক্ষেত্র’-এর প্রসারের কাজটা অবশ্য দীর্ঘদিন থমকে ছিল। বাম আমলে বিধাননগরকে ‘পাইনঅ্যাপ্ল এক্সপোর্ট জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আনারস উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে বাগডোগরা থেকে দেশ-বিদেশে আনারস পাঠানোর সুযোগও ছিল। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। ভাল হিমঘর, গবেষণা কেন্দ্র, সহজে সার মেলার ব্যবস্থায় খামতি রয়েছে।
এত দিনে বিধাননগর পাইনঅ্যাপ্ল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। সংগঠনের এক কর্তা কাজল ঘোষ বলছেন, “এতদিনে প্রশাসন আমাদের আবেগটা ধরতে পেরেছে। উৎসবের পরে হয়তো এগিয়ে চলার দরজা খুলে যাবে।” কোচবিহারের উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল ও ফলনোত্তর পরিচর্যা বিভাগের শিক্ষক নীলেশ ভৌমিকও আশাবাদী। জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ তৈরি শেখাতে আনারস-উৎসবে সামিল হচ্ছেন তাঁরাও।
এত বড় উৎসবেও বিতর্ক অবশ্য পিছু ছাড়ছে না। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের সভাধিপতি পাসকেল মিন্জ বলছেন, “আমাদের কিন্তু কেউ নিমন্ত্রণ করেননি। পরিষদে কোনও কার্ড আসেনি। হয়তো আমি সিপিএমের লোক বলেই..।” এসজেডিএ-র দাবি, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সব প্রতিনিধিকেই সসম্মানে আমন্ত্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শেষমেশ আনারসের মিষ্টিই সব অভিমান মুছে দেবে আশায় আশায় রয়েছে শিলিগুড়ি। |