রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কর্মীরা আসবেন কলকাতায়। সে জন্য বহু আগে টিকিট কেটেও ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় উঠতে গিয়ে ‘দুর্ভোগ’ যাত্রীদের। বাম-আমলেও মাঝেমধ্যেই এ ধরনের অভিযোগ শোনা যেত। রবিবার রাতে উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতাগামী একাধিক ট্রেনের যাত্রীদের অভিজ্ঞতা, সেই ‘ঐতিহ্য’ অপরিবর্তিত। অভিযোগের আঙুল উঠেছে ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন অনুষ্ঠানে (আজ, মঙ্গলবার) যোগ দিতে কলকাতায় আসা ছাত্র পরিষদ (সিপি) এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) কর্মী-সমর্থকদের দিকে।
অভিযোগ নানা রকম। উত্তর দিনাজপুরের আলুয়াবাড়িতে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত কামরায় ‘জবরদখলকারী’ টিএমসিপি-র কিছু ছেলের ‘দাদাগিরি’র প্রতিবাদ করায় এক যুবককে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ পেয়েছে রেল পুলিশ। এমনকী, ওই যুবকের অন্তঃসত্ত্বা বোনকেও ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে। নিউজলপাইগুড়িতে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসের ২৫ জন যাত্রীকে ‘ভয় দেখিয়ে’ ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় উঠতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পেয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। এমনকী, রাজনৈতিক কর্মীদের ‘সৌজন্যে’ সংরক্ষিত কামরার টিকিট থাকা যাত্রী মেঝেয় মালপত্রের উপরে বসে আসতে বাধ্য হন বলেও উঠেছে অভিযোগ।
দিল্লিতে ফোনে যোগাযাগ করা হলে রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের বক্তব্য, “এ রকম অভিযোগ আমিও শুনেছি।” তাঁর দাবি, “খবর পাওয়া মাত্রই লোক পাঠিয়ে ওই সব
ছাত্রদের ট্রেনের সংরক্ষিত কামরা থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম দেব বলেছেন, “দলনেত্রীর (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, সংরক্ষিত কামরার যাত্রীদের অসুবিধেয় ফেলে দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া যাবে না। তার পরেও এমন অভিযোগ ওঠায় আমি বিরক্ত। দলীয় ভাবে বিশদে খোঁজখবর নেব। অভিযোগের সত্যতা রয়েছে বলে প্রমাণ পেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে টিএমসিপি-র উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। যাঁরা যাত্রী হেনস্থার অভিযোগ করছেন, তাঁরা ভুল বলছেন।” তাঁর সংযোজন, “ট্রেনে ছাত্র পরিষদের ছেলেরাও ছিল।” পক্ষান্তরে ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি রাহুল রায় বলেন, “আমাদের কেউ সংরক্ষিত কামরায় ওঠেননি। যাঁরা সাধারণ কামরায় উঠতে পারেননি, তাঁরা ফিরে গিয়েছেন। সংরক্ষিত কামরায় উঠেছে টিএমসিপি।”
যারা ট্রেনের কামরায় আসন জবরদখল করেছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানেন না জলপাইগুড়ির নবনীতা মণ্ডল। মাকে চিকিৎসা করাতে ট্রেনে কলকাতায় নিয়ে আসছিলেন। মা, স্বামী ও নিজের জন্য প্রায় দু’মাস আগে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে তিনটি আসন সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। নবনীতাদেবীর অভিযোগ, নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের তেরঙা পতাকা নিয়ে কিছু যুবক তাঁদের কামরায় ওঠে। তারা নবনীতাদেবীদের আসন থেকে সরিয়ে দেয়। নবনীতার ক্ষোভ, “কত বার বললাম, আমার মা অসুস্থ। ওরা কোনও কথাই কানে তুলল না! কামরার মেঝেয় মালপত্র রেখে তার উপরেই বসে শিয়ালদহ পর্যন্ত এসেছি। পথে টিকিট পরীক্ষক এবং রেল রক্ষী বাহিনীর জওয়ানদেরও প্রতিকারের জন্য বলি। ফল হয়নি।”
আলুয়াবাড়িতে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরায় বোন গুড়িয়া ও ভগ্নিপতি সরফরাজ আহমেদকে রবিবার তুলে দিতে এসেছিলেন ইসলামপুরের তাসির হোসেন। লেপ-তোশকের কারিগর তাসিরের অভিযোগ, ওই দু’টি আসন সংরক্ষিত থাকলেও তৃণমূলের ব্যাজধারী এক দল যুবক, সেখানে গুড়িয়াদের বসতে দেয়নি। তা নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাঁকে ও গুড়িয়াকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মারা হয়। দু’জনকে পড়ে যেতে দেখে সরফরাজ চেন টেনে ট্রেন থামান বলে দাবি ওই পরিবারের। অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ওই রাতেই আলুয়াবাড়িতে রেল পুলিশের থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম।
তবে শিলিগুড়ির রেল পুলিশের ডেপুটি সুপার পিনাকী মজুমদার বলেন, “ওই যুবক ও তাঁর বোনকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মারার যে অভিযোগ হয়েছে, তাতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। ওই যুবক কী ভাবে ট্রেন থেকে পড়লেন, তা স্পষ্ট নয়। যুবকটির তেমন চোট লাগেনি। ওঁর বোন হাসপাতালে পর্যন্ত যাননি।” ওই রেল পুলিশ কর্তার বক্তব্য, “আমাদের অনুমান, যুবকটিকে পড়ে যেতে দেখে চেন টেনে যুবকের বোন ও ভগ্নিপতি নেমে পড়েন। রেল পুলিশ চেন টানার কারণ জানতে চাইলে ওঁরা ঠেলে ফেলার অভিযোগ নিয়ে চেঁচামেচি করেন। সব দিক খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করব।” এক ধাপ এগিয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সুব্রত হাজংয়ের দাবি, “ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা তদন্তে মেলেনি।”
তাসিরকে প্রথমে ইসলামপুর হাসপাতাল ও পরে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে পাঠানো হয়। সেখানে সিটি স্ক্যানের পরে তাঁর মাথায় বড় মাপের কোনও চোট নেই বলে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন। সোমবার দুপুরে জখম যুবক নার্সিংহোমে ভর্তি হতে চান না বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে বাড়ি ফিরে যান। পরিবারটির দাবি, গুড়িয়া লাইনের পাশে জলে পড়ায় তাঁর চোট লাগেনি।
আলুয়াবাড়ির ঘটনা নিয়ে রেল ও পুলিশের সঙ্গে অভিযোগকারীদের মতবিরোধ রয়েছে। তবে রবিবার রাতে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক হাজার যাত্রীকে যে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তা ঘনিষ্ঠ মহলে রেল ও পুলিশের অনেক কর্তাই মেনেছেন। রেল সূত্রের খবর, ওই রাতে এনজেপি স্টেশনের একাধিক অফিসার-কর্মী বৈধ টিকিটধারী যাত্রীদের কাছে জোড়হাতে দুঃখপ্রকাশ করেন। টিকিট থাকলেও ট্রেনে উঠতে ‘বাধা পাওয়া’ যাত্রীদের পরে অন্য ট্রেনে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
রেল পুলিশ এবং রেল রক্ষী বাহিনী থাকতে এমন পরিস্থিতি হল কেন?
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক বলেন, “যাত্রীদের হয়রানি হয়ে থাকলে আমরা দুঃখিত। রবিবার রাতের ঘটনার পরে জিআরপি ও আরপিএফকে ফের বার্তা পাঠিয়ে বৈধ টিকিটধারীদের যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য বাড়তি নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” |