চিকিৎসায় সংরক্ষণের প্রশ্নে দানা বাঁধছে বিতর্ক
সংখ্যালঘুদের জন্য রাজ্য গড়তে চাইছে হাসপাতাল
মূলত রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি স্বতন্ত্র মেডিক্যাল কলেজ ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। ওই উদ্দেশ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে জমিও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও হাসপাতালের পরিষেবা বিশেষ কোনও ধর্মাবলম্বীদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখা যায় কি না, সেই প্রশ্নে উদ্যোগটির গোড়া থেকেই বিতর্ক দানা বাঁধছে। ধর্মের ভিত্তিতে শয্যা সংরক্ষিত থাকবে এমন কোনও হাসপাতালের বৈধতা নিয়ে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই) প্রশ্ন তুললেও রাজ্য সরকার এখনও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। পরিকল্পনা-প্রস্তাবটিতে যোজনা কমিশনের অনুমোদন আদায়ের লক্ষ্যে তার বিস্তারিত প্রকল্প-রিপোর্ট (ডিপিআর) চেয়ে ইতিমধ্যে পূর্ত দফতরকে চিঠিও দিয়েছে সংখ্যালঘু দফতর।
এমসিআই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, হাসপাতালে রোগীকে শয্যা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনও ধর্মীয় ‘কোটা’ থাকতে পারে না। রোগই এখানে একমাত্র বিবেচ্য। কাউন্সিলের এক কর্তার কথায়, “রোগীর আবার কোনও ধর্ম হয় নাকি? রোগী রোগীই।” আর এক কর্তার মন্তব্য, “রক্তদান শিবিরে সংগৃহীত রক্ত যেমন ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করে রাখা হয় না, হাসপাতালের বেডও তা-ই। যার প্রয়োজন, তাঁর ঠাঁই হবে। এর বাইরে কিছু হতে পারে না।” উপরন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই আছে, হাসপাতাল কোনও রোগীকে চিকিৎসা না-করে ফেরাতে পারবে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের হাসপাতালে অন্য ধর্মাবলম্বী রোগী এলে তাঁকে যদি ভর্তি করা না-হয়, তা হলে শীর্ষ আদালতের নির্দেশও অমান্য করা হবে বলে এমসিআইয়ের দাবি।
তবে এই সব প্রশ্নের মুখে পড়েও রাজ্য সরকার বিচলিত নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা একটা হাসপাতাল গড়ার উদ্যোগ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রকল্পটির জমি পরিদর্শন করতে শিগগিরই আমি ভাঙড় যাব।” উল্লেখ্য, মেডিক্যাল কলেজের জন্য নির্দিষ্ট ভাঙড়ের ওই ২২ একর আয়তনের জমিটি আদতে কলকাতা পুরসভার। পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ জানান, এক টাকার বিনিময়ে রাজ্যকে জমিটা লিজ দিয়েছে পুরসভা।
স্বাস্থ্য দফতরের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভাঙড়ের ওই জমিতে প্রধানত সংখ্যালঘুদের চিকিৎসার লক্ষ্যে পাঁচশো শয্যার একটি মাল্টি স্পেশ্যালিটি ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং একশো আসনের মেডিক্যাল কলেজ গড়া হবে। পিছিয়ে পড়া এলাকা উন্নয়নের বিশেষ কেন্দ্রীয় তহবিল (ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়নস গ্রান্ট ফান্ড, সংক্ষেপে বিআরজিএফ) থেকে ইতিমধ্যে এই খাতে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিআরজিএফের টাকা পেতে হলে যোজনা কমিশনে ডিপিআর পাঠাতে হয়। সেই রিপোর্ট তৈরি করতে বলেই পূর্ত দফতরকে সম্প্রতি সংখ্যালঘু দফতরের তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এবং ‘মূলত রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ তৈরির সিদ্ধান্তের’ উল্লেখ রয়েছে ওই চিঠিতেও।
বিআরজিএফ থেকে না হয় চল্লিশ কোটি মিলবে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব তো বলছে, একটা মেডিক্যাল কলেজ চালু করতে গেলে লাগবে অন্তত ১০০ কোটি! বাকিটার সংস্থান হবে কী ভাবে?
দফতর সূত্রের বক্তব্য: এ ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি)-এর কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন মেডিক্যাল কলেজটি পুরোপুরি রাজ্য সরকারের হাতে থাকুক। তাই পিপিপি’র ভাবনা আপাতত মুলতুবি। এক স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা, হাসপাতাল বেসরকারি হাতে গেলে শেষমেশ বেড সংরক্ষিত রাখা যাবে না। তাই সরকারি তরফেই বাকি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা হবে।”
সরকার কী ভাবে ওই টাকার সংস্থান করবে, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। একই ভাবে নতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য শিক্ষক-চিকিৎসক মিলবে কোথা থেকে, সে প্রশ্নও বড় হয়ে উঠেছে। কারণ সাগর দত্ত, মালদহ ও বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাবে ধুঁকছে। পরিকাঠামো না-থাকায় এমসিআই তিনটিতেই পড়ুয়াভর্তির অনুমোদন বাতিল করে দিয়েছিল, এক বছরের মধ্যে শিক্ষক-চিকিৎসক ও অন্যান্য পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করার মুচলেকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত অনুমোদন বহাল রাখা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে ন তুন আরও একটা মেডিক্যাল কলেজ চালু হলে সেখানে পড়াবেন কারা? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার দাবি, “ডাক্তারের সংখ্যা কম বলেই রাজ্যে আরও বেশি করে মেডিক্যাল কলেজ দরকার। গোড়ায় ক’দিন সমস্যা হবে ঠিকই। পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: ভাঙড়ের প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়াদের আসন ও রোগীদের শয্যা দু’ক্ষেত্রেই সংরক্ষণের কথা বলা হয়। কিন্তু কিছু দিন আগে অন্ধ্র-কেরলে শিক্ষায় আসন সংরক্ষণের চেষ্টার সমালোচনা করে মেধাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এমতাবস্থায় নতুন মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রভর্তিতে ধর্ম-ভিত্তিক সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত রাজ্য এই মুহূর্তে নিতে চাইছে না। রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতরের সচিব বিক্রম সেন বলেন, “ভেলোরের খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজ কিংবা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ মেডিক্যাল কলেজের আদলে ভাঙড়ের মেডিক্যাল কলেজটি গড়ার কথা ভাবা হচ্ছে।” ওই দুই প্রতিষ্ঠানে কী ব্যবস্থা?
ভেলোরের কলেজ-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ভর্তির ক্ষেত্রে ধর্ম-ভিত্তিক কোনও কোটা নেই, হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে তো নেই-ই। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মহম্মদ জুনাইদ জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে মেধার ভিত্তিতে পঠন-পাঠন এবং রোগের গুরুত্বের নিরিখে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হয়। সংরক্ষণের প্রশ্ন নেই।
তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কীসের ভিত্তিতে এমন একটি পদক্ষেপ করতে চলেছে? রাজ্য সরকার এখনই এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ। বরং সুশান্তবাবু বলছেন, “এত তাড়া কীসের? ধাপে ধাপে যেমন এগোবে, তেমনটাই সকলে জানতে পারবেন।” অন্য দিকে এমসিআইয়ের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগটি সম্পর্কে এখনও আমরা লিখিত কোনও প্রস্তাব পাইনি। লিখিত প্রস্তাব যদি আসে, এবং সত্যিই যদি তাতে এমন পরিকল্পনার কথা বলা থাকে, তা হলে অবশ্যই আমরা আমাদের বক্তব্য জানাব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.