বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: দুই মাইলফলক বিজ্ঞানের কলকাতায়
জগদীশচন্দ্র, সি ভি রামনের
গবেষণাকে কুর্নিশ বিশ্বের

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১২। কলকাতার জীবনে তারিখটা হতে চলেছে বিশেষ স্মরণীয় একটি দিন। বিশ্ব-বিজ্ঞান এ দিন সেলাম জানাবে এই শহরকে। স্মরণ করবে তার দুই সন্তানের আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে, যা পাল্টে দিচ্ছে দুনিয়া।
এক জনের তুলনা হয়তো মহাকাব্যের অর্জুন। সাফল্য অর্জনের সঙ্গে স্বীকৃতি অন্বেষণেও যিনি ছিলেন সমান তৎপর। চমকে দেওয়া আবিষ্কারের পর নোবেল কমিটির ঘোষণার অপেক্ষায় না থেকে, আগাম কেটে ফেলেছিলেন পুরস্কার নিতে যাওয়ার টিকিট। তিনি চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন।
আর দ্বিতীয় সন্তান? তাঁর প্রিয় যেন মহাকাব্যের বিশেষ চরিত্র কর্ণ। পুরস্কার ভুলে তিনি মগ্ন ছিলেন আপন জীবনচর্চায়, বিজ্ঞানের সাধনায়। বেতার যোগাযোগের মতো সাংঘাতিক আবিষ্কারের পরেও নেননি তার পেটেন্ট। তাই হয়তো জীবন তাঁর ‘জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত’, ‘আশাহীন কর্মের উদ্যম’। তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।
তাঁদের গবেষণায় প্রাণ পেয়েছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি। বদলেছে দুনিয়া। ইঞ্জিনিয়ারদের বিশ্বসংগঠন ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারস (পরিচিত নাম আই-ট্রিপল-ই)-এর বিচারে চন্দ্রশেখর এবং জগদীশের সাফল্য প্রযুক্তির ইতিহাসে ‘মাইলফলক’।
জগদীশচন্দ্র বসু সি ভি রামন
দু’জনকে কুর্নিশ জানাতে আই-ট্রিপল-ই-র প্রেসিডেন্ট পিটার স্টেকার নিউ জার্সি থেকে আসছেন ১৪ সেপ্টেম্বর। পর দিন তিনি এই দুই বিজ্ঞানীর স্মরণে ‘মাইলফলক’ বসাবেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। রীতিমতো খুশি আই-ট্রিপল-ই-র কলকাতা শাখার সভাপতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবাজী চক্রবর্তী। বললেন, “সভ্যতা এগোচ্ছে প্রযুক্তির হাত ধরে। প্রযুক্তির ইতিহাসকে সেলাম জানাতে আই-ট্রিপল-ই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চন্দ্রশেখর এবং জগদীশকে কুর্নিশ ওই অভিপ্রায়ের অঙ্গ। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া বাদ দিলে এশিয়ার আর কোনও দেশে এমন মাইলফলক বসেনি এ পর্যন্ত। কলকাতার সুবাদে ভারত এই মহাদেশে তৃতীয় দেশ, যা পাচ্ছে ওই সম্মান।”
কোথায় বসানো হবে ফলক দু’টি? আই-ট্রিপল-ই-র নিয়ম, তা বসবে খোদ বিজ্ঞানীর কর্মস্থল বা ঠিক পরীক্ষার জায়গাটিতে। তা গবেষণারের বিশেষ ঘর হোক বা খোলা মাঠ। কিন্তু ইতিহাস-উদাসীন বাঙালি বাঁচিয়ে রাখেনি বউবাজার স্ট্রিটে চন্দ্রশেখরের ল্যাবরেটরি কিংবা প্রেসিডেন্সিতে জগদীশের গবেষণাগার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিও-ফিজিক্সের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রদীপকুমার সাহা বললেন, “আলোচনা করে আমরা ঠিক করলাম, প্রেসিডেন্সিতে উপাচার্যের ঘরের সামনে বসানো হোক জগদীশচন্দ্রের নামাঙ্কিত ফলক। আর অতীতে চন্দ্রশেখরের প্রতিষ্ঠানের নতুন বাড়ি যখন যাদবপুরে, তখন ওখানেই বসুক তার নামের ফলক।”
২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮। চন্দ্রশেখর চমকে উঠেছিলেন তাঁর পরীক্ষার ফলে। রঙিন আলো কোনও তরলে প্রবেশ করলে তার যে অংশ বিচ্ছুরিত হয় সেটার চরিত্র ভারি অদ্ভুত। রামন এফেক্ট। তা থেকে আজকের প্রযুক্তি? ব্যাখ্যা দিলেন রেডিও-ফিজিক্সের আর এক প্রাক্তন অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বসু। বললেন, “পদার্থকণা ইলেকট্রন থেকে ইলেকট্রনিক্স। একই ভাবে আলোর কণা ফোটন ব্যবহারকারী প্রযুক্তি ফোটনিক্স। এই শাস্ত্রকে নতুন পথ দেখাচ্ছে রামন এফেক্ট। অপটিক্যাল ফাইবার মারফত দূরযোগাযোগ কিংবা ইন্টারনেট সুপার হাইওয়ে-র মূলে রামনের গবেষণা।”
এটা আমার কাছে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা, আমার দাদু গাগলিয়েলমো মার্কনির আগে স্যার জে সি বোসই প্রথম বেতার যোগাযোগের পরীক্ষাটি করেছিলেন।
... ফ্রান্সেসকো পারেশে মার্কনি
৩০ নভেম্বর, ২০০৬
আর জগদীশচন্দ্র? ১৮৯৪ সালের নভেম্বর। প্রেসিডেন্সি কলেজে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গবেষণাগার। সেখানে জগদীশ তৈরি করলেন অদৃশ্য আলো। বেতার তরঙ্গ। ঘরে তিন জন। প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র এবং দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে জগদীশের প্রিয় শিক্ষক ফাদার ই লাফো।ঁ জগদীশের তৈরি বেতার তরঙ্গ দেওয়াল ভেদ করে পৌঁছলো পাশের ঘরে। সেখানে বসে আছেন প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপাল আলেকজান্ডার পেডলার। তাঁর ঘরে পৌঁছে তরঙ্গ কাজ করল রিমোট কন্ট্রোলের। তরঙ্গের প্রভাবে নড়ল একটা পিস্তলের ট্রিগার। ফায়ার! প্রথম বেতার সঙ্কেত। যার সূত্রে আজকের টেলিকমিউনিকেশন। এমনকী মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিও। তবু স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত জগদীশচন্দ্র। ১৯০৯-এ বেতার যোগাযোগ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পেলেন ইতালির গাগলিয়েলমো মার্কনি এবং জার্মানির কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রাউন।
এ ব্যাপারে এক তথ্য দিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির-এর অধিকর্তা শিবাজী রাহা, “২০০৬-এ ব্যক্তিগত সফরে কলকাতা এসেছিলেন মার্কনির নাতি ফ্রান্সেসকো পারেশে মার্কনি। সে দিন ৩০ নভেম্বর, জগদীশচন্দ্রের জন্মদিন। আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎই আমাদের ইনস্টিটিউটে চলে আসেন ফ্রান্সেসকো। তিনি নিজে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, কাজ করেছেন নাসায়। ১৯৭৫-এ তাঁর কাজ যুক্ত ছিল অ্যাপোলো-সয়ুজ উৎক্ষেপণের সঙ্গে। এখন গবেষণা করেন ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও নাসার হাবল টেলিস্কোপ প্রকল্পের পরামর্শদাতা ইতালীয় সংস্থায়। এহেন ফ্রান্সেসকো ঘুরে দেখেন আমাদের মিউজিয়াম। আচার্যের যন্ত্রপাতি দেখে অভিভূত হয়ে যান। এমন সব তুচ্ছ যন্ত্র দিয়ে এত বড় আবিষ্কার! আমাদের না জানিয়ে ফ্রান্সেসকো ভিজিটরস বুক-এ লেখেন তাঁর মন্তব্য: ‘এটা আমার কাছে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা, আমার দাদু গাগলিয়েলমো মার্কনির আগে স্যার জে সি বোসই প্রথম বেতার যোগাযোগের পরীক্ষাটি করেছিলেন।...”
কেমব্রিজে ক্রাইস্ট কলেজে পড়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। ২০০৮-এ সেখানে আচার্যের মূর্তি উন্মোচন করতে গিয়েছিলেন শিবাজী। বিদেশে জগদীশচন্দ্রকে সম্মান জানানোর উৎসাহ মুগ্ধ করেছিল তাঁকে। প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত সেই জগদীশচন্দ্রকে সম্মান জানাতে আই-ট্রিপল-ই-র উদ্যোগে শিবাজীর মন্তব্য, “দেরিতে হলেও হচ্ছে। সেটাও ভাল!” ‘দেরিতে হলেও’ ১৫ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞানচর্চায় সাফল্যের দু’টি মাইলফলক পাবে বিশ্ব-মানচিত্র। ফলক দু’টিই মনে করিয়ে দেবে, এই কলকাতারই ভিতরে ছিল আর একটা কলকাতা। সে তখন দেশের রাজধানী, পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শহর। তার চেয়েও বড় কথা বাংলার রেনেসাঁসের হাত ধরে সে কলকাতা তখন গোটা উপমহাদেশে জ্ঞানান্বেষণের কেন্দ্রবিন্দু। সেই উজ্জ্বল ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ উঠতে নিজের কাছেই যেন প্রশ্ন করে বসলেন রেডিও-ফিজিক্সের অধ্যাপক দেবতোষ গুহ, “আবার কবে তেমন দিনে ফিরব আমরা?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.