বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেমে গেল চন্দ্রজয়ীর জীবন
“চাঁদ থেকে বলছি, আমি পৃথিবীর মানুষ। হ্যাঁ এইমাত্র চাঁদের ভেলা ঈগলে চেপে আমরা এখানে নামলাম। আমি নিল আর্মস্ট্রং আর আমার সঙ্গী অলড্রিন।”
১৯৬৯ সালের ২২ জুলাই। সে দিনের আনন্দবাজার পত্রিকায় মানুষের চন্দ্রবিজয়ের খবর শুরুই হয়েছিল নিল আর্মস্ট্রংয়ের এই ঐতিহাসিক কথাগুলি দিয়ে। তিনটি মাত্র বাক্যে শিহরিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব। ঠান্ডা লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ওই উচ্চারণ। চন্দ্র পদতলে!
এর দু’দিন আগে, ২০ জুলাই। শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় নাসার গবেষণাগারে রেডিওর ওপার থেকে ভেসে এসেছিল বার্তা, “হিউস্টন, ট্রাঙ্কুইলিটি বেস-এ পৌঁছে গিয়েছি। ঈগল ঠিক ভাবেই মাটিতে নেমেছে।” তার ১০ ঘণ্টা পরে ভারতীয় সময় তখন সকাল ১০টা বেজে ৫৭ মিনিট, রুদ্ধশ্বাস গোটা বিশ্ব।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৬৯ সালের ২২ জুলাই। চাঁদের মাটিতে প্রথম পা।
সম্ভব হবে কি? তাঁরা কি পারবেন? নাসার টিভিতে দেখা গেল মই বেয়ে অদ্ভুত পোশাক পরে ধীরে ধীরে নামছেন ৩৮ বছরের মার্কিন মহাকাশচারী নিল আর্মস্ট্রং। অবশেষে চাঁদের মাটিতে ‘একটা ছোট্ট পদক্ষেপ’।
সূচনা হল মানব সভ্যতার এক নতুন যুগের। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধে আমেরিকার এত বড় সাফল্য চমকে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এত হইচই, চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখা নিল আর্মস্ট্রং বরং ছিলেন নিস্পৃহ। কিছুটা বিরক্তও। পরে অনেক সময়েই বলতেন, “এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে!” এক সাক্ষাৎকারে চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছিলেন, “জায়গাটা বেশ ভাল। ওখানে যাওয়া যেতেই পারে।” ব্যস এইটুকুই।
জন্ম ওহায়োর ওপাকোনেতায় ১৯৩০ সালের ৫ অগস্ট। ছোটবেলা থেকেই বিমানে চড়তে ভালবাসতেন। আর্মস্ট্রংয়ের জীবনীকার জেমস হানসেন খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই মহাকাশচারীকে। তাঁর কথায়, “নিলের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জুড়ে গিয়েছিল উড়ে বেড়ানোর নেশা।” মাত্র ৬ বছর বয়সে প্রথম বিমান চড়ার অভিজ্ঞতা। সেই শুরু। বিমান চালানোর প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ জোগাড় করার জন্য নানা রকম কাজ করতেন। ভালবাসতেন বিমানের নানা নকশা তৈরি করতে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিলেন। বিজ্ঞান আর অঙ্কে পারদর্শিতার জন্য ১৯৪৭-এ ইন্ডিয়ানার পুদ্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নেভি স্কলারশিপ’ পেয়ে ভর্তি হন বিমানবাহিনীতে। এর দু’বছর পরেই বিমানবাহিনীর চালক হিসেবে কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন। অসামান্য পারদর্শিতার জন্য তিনটি পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আর বিমানবাহিনীতে থাকতে ভাল লাগেনি তাঁর।
অ্যাপোলো-১১
মহাকাশযানের ভিতরে।
অ্যাপোলো অভিযানের আগে
মহাকাশচারীর পোশাকে তিনি।
ফের পড়াশোনা শুরু। ১৯৫৫ সালে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হয়ে যোগ দেন তৎকালীন ‘ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কমিটি অন এরোনটিকস (নাকা)’-এ। ১৯৫৮ সাল থেকে যা নাম পাল্টে হয় ‘নাসা’।
১৯৬২ সালে নাসার মহাকাশচারী হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযান করে চন্দ্রাভিযানের আগেও কয়েক বার মহাকাশে গিয়েছিলেন আর্মস্ট্রং। মহাকাশচারী হিসেবে তাঁর দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়েই রোবটের বদলে চাঁদে মানুষ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় নাসা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াইয়ে জিততে যে অভিযানকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল করেছিল আমেরিকা। এই অভিযানের কম্যান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয় আর্মস্ট্রংকে। সঙ্গী ছিলেন আরও দুই মহাকাশচারী এডুইন বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিনস। পৃথিবী থেকে চাঁদ, ১৯৫ ঘণ্টার এই যাত্রায় প্রায় ৪ লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করেছিলেন নিলরা। অ্যাপোলো-১১র সঙ্গে আটকানো ছিল ‘ঈগল’ নামের একটা ভেলা। যাতে করে চাঁদের মাটিতে নেমেছিলেন নিল আর এডুইন।
জন্মদিনের ঠিক দু’দিন পরেই বাইপাস সার্জারি হয় তাঁর। কিন্তু ৮২ বছরের শরীর সইতে পারলেন না এত
বড় ধকল। চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখা মানুষটিকে আর হাঁটতে দেখা যাবে না
পৃথিবীর মাটিতে।
চন্দ্রাভিযানের ৪৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে নিল আর্মস্ট্রং।
প্রচারের আলো থেকে বরাবরই দূরে থাকতে ভালবাসতেন আর্মস্ট্রং। ১৯৬৯-এর অ্যাপোলো-১১ অভিযানই তাঁর শেষ মহাকাশ অভিযান। এর এক বছর পরেই সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ এসেছিল। কিন্তু সতীর্থ মহাকাশচারী জন গ্লেন বা হ্যারিসন স্মিটের মতো সে পথে পা বাড়াননি তিনি। বরং পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। জনসমক্ষে খুব কমই আসতেন তিনি। বছর কয়েক আগে মহাকাশ কেন্দ্র থেকে মার্কিন মহাকাশচারীদের আনতে বা ওই কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বিদেশি মহাকাশযান ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাঁর বিরোধিতা করে এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন আর্মস্ট্রং।
বিতর্কও অবশ্য কম হয়নি তাঁদের এই অভিযানকে ঘিরে। অনেকেই বলে থাকেন আদৌ চাঁদের মাটিতে পা-ই দেননি আর্মস্ট্রংরা। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘হারাতে’ এ আমেরিকার ‘চক্রান্ত’। চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে নাসার উদ্দেশে ‘একটা’ মানুষের ছোট্ট পদক্ষেপ বলা নিয়েও বিতর্ক ওঠে। অভিযোগ ওঠে, তিনি ওই ‘একটা’ কথাটাই বলেননি। বলা হয়, তিনি খুব অহঙ্কারী। যদিও পরে এই কথা বলা নিয়ে ভুল স্বীকার করেন তিনি। তবে বিতর্ক যা-ই থাকুক, মানুষের কল্পনাকে বাস্তবে রূপদানের জনক জীবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে গেলেও চাঁদের মাটিতে আজও থেকে যাওয়া তাঁর পায়ের ছাপই (যদি না ঝড়ে মুছে গিয়ে থাকে) তাঁকে পরিণত করেছে কিংবদন্তিতে। যা দেশ কালের সীমা ছাড়িয়ে কুর্নিশ করে মানুষের সত্যান্বেষণকেই।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.