জুলুমের জেরে দায়িত্ব ছাড়তে চায় সংস্থা
মাল খালাসে মান্ধাতার আমলে ফিরছে হলদিয়া
ক দিকে শ্রমিক অসন্তোষ, শাসক দলের হুমকি ও রাজনৈতিক দাদাগিরি, অন্য দিকে বন্দর কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা এই দুই অভিযোগে হলদিয়া বন্দর ছাড়তে চাইছে পণ্য খালাসে দেশের অন্যতম বড় সংস্থা এবিজি গোষ্ঠী। অভিযোগ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিসও পাঠিয়েছে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর থেকে হলদিয়ায় কাজ বন্ধ করে দেবে সংস্থাটি। ফলে নাব্যতার সঙ্কটে ভোগা বন্দরটি যন্ত্রের থেকে আবার পুরোপুরি কোদাল-বেলচার যুগে ফিরে যাবে।
নতুন সরকার প্রথম থেকেই নিজেদের ‘শিল্পবন্ধু’ ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শিল্পমহলের একটি বড় অংশের ধারণা, এবিজি গোষ্ঠী যদি হলদিয়া ছেড়ে চলে যায়, তা হলে সেই ভাবমূর্তি গড়ার প্রয়াস জোর ধাক্কা খাবে। একই সঙ্গে মনে করা হচ্ছে, হলদিয়ার ঘটনা নিয়ে শাসক দলের একাংশ যে ভূমিকা নিয়েছে, তাতে বন্দর শিল্পে আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে ‘অন্য রকম’ বার্তা যেতে পারে। এ সব কারণে শেষ পর্যন্ত এবিজি গোষ্ঠী চলে গেলে হলদিয়া বন্দর বছরে অন্তত ১২৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। রোজগারের অঙ্কে রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলে হলদিয়া বন্দর তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাবে।
বছর পাঁচেক আগে জাহাজ মন্ত্রক দেশের ১১টি বৃহৎ বন্দরের আধুনিকীকরণের নীতি নিয়েছিল। সেই সূত্রে যন্ত্রনির্ভর পণ্য খালাস ব্যবস্থা চালু করতে ২০০৯-এর এপ্রিলে বিজ্ঞাপন দেন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ। সবচেয়ে কম দর দিয়ে সেই বছরেরই অক্টোবর মাসে হলদিয়া বন্দরের ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য খালাসের বরাত পায় মুম্বইয়ের এবিজি গোষ্ঠী। আরও প্রায় এক বছর পরে বার্থ দু’টিতে ‘মোবাইল হারবার ক্রেন’ বসিয়ে পণ্য খালাস চালুও হয় (চলে গেলে এই যন্ত্র দু’টি নিয়ে যাবে এবিজি। ফলে যন্ত্রযুগ থেকে আবার কোদাল-বেলচায় ফিরতে হবে বন্দরকে)। কিন্তু গোড়া থেকেই লাগাতার শ্রমিক অসন্তোষ এবং আধুনিকীকরণ বিরোধী একটি মহলের চাপে পড়ে এখন নাজেহাল সংস্থাটি বিদায় নিতে চাইছে। গত বৃহস্পতিবার, ২৩ অগস্ট কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষকে যে নোটিসটি পাঠিয়েছে তারা, সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, শুরু থেকেই শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। বরাত পাওয়ার পরেও বিরোধিতার জেরে সাত মাস হলদিয়া বন্দরে ঢুকতে পারেনি তারা। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে পুলিশ প্রহরায় যন্ত্রপাতি-সহ ওই দুই বার্থে পা রাখে তারা।
নোটিসে সংস্থার আরও অভিযোগ, যন্ত্র আনার জন্য দু’টি বার্থে ৩৫০ জন শ্রমিক নিয়োগই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ইউনিয়নের দাবি, যন্ত্র বসানোর আগে ওই দু’টি বার্থে যত শ্রমিক কাজ করতেন, তাঁদের সকলকে নিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, যে কাজের জন্য ৩৫০ জন শ্রমিকই যথেষ্ট, সেখানে বাড়তি ২৭৭ জন (মোট ৬২৭) শ্রমিককে নিতে হবে এবিজি-কে। সমস্যা মেটাতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক সাংসদ, শ্রমিক সরবরাহকারী এক সংস্থা এবং বন্দর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবিজি কতৃর্পক্ষ। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ৩৫০ জন শ্রমিক লাগলেও দুটি বার্থে ৬২৭ জনকেই নেবে তারা। পরিবর্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ এই দুই বার্থে মাসে ৯ লক্ষ টন পণ্য খালাস নিশ্চিত করবে। কিন্তু পরবর্তী কালে ওই দুই বার্থে শ্রমিক সংখ্যা বাড়লেও পণ্য খালাস বাড়েনি। ফলে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩৪ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে সংস্থাটির। এখন প্রতি মাসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি টাকা করে। বাড়তি শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান খরচ এবং কম পণ্য খালাসের জন্য আয় সমানে কমে যাওয়ায় চাপে পড়ে তারা হলদিয়া ছাড়তে চাইছে।
এবিজি-র চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার গুরপ্রীত মালহি বলেন, “বন্দর কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলির জুলুমবাজি আমাদের চলে যাওয়ার মূল কারণ। তা ছাড়া আধুনিকীকরণ বিরোধী একটি কায়েমি চক্রও এখানে সক্রিয়। টাটাদের রাজ্য ছাড়তে হয়েছে, এ বার আমরাও পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরে আসব।” গুরপ্রীত আরও জানান, ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে এবিজি দিনে ২০ হাজার টন করে পণ্য খালাস করতে পারে। প্রতি টনে বন্দরের রোজগার হয় ১৫২ টাকা, এবিজি-র ৭০ টাকা। অন্য বার্থগুলিতে দিনে মাত্র ৫ হাজার টন পণ্য খালাস হয়। প্রতি টনে বন্দরের রোজগার হয় মাত্র ৬০ টাকা। তা সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি মতো ৯ লক্ষ টনের পরিবর্তে মাসে প্রায় অর্ধেক পণ্য খালাস করার সুযোগ পাচ্ছে এবিজি। তাঁর অভিযোগ, “২ এবং ৮ নম্বর বার্থে জাহাজই ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ চাপে পড়ে দ্বিগুণ সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে তাঁদের বেতন দিতে হচ্ছে।”
শ্রমিক ইউনিয়নের জুলুমবাজি নিয়ে যে অভিযোগগুলি উঠেছে, তা একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন তমলুকের (বন্দর এই এলাকার মধ্যেই) তৃণমূল সাংসদ তথা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারী। এবিজি-র অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “পুরো দায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং লক্ষ্মণ শেঠের। শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে চুক্তি করেছিল এবিজি। সেই পুরনো চুক্তি মেনেই বর্তমান শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবি তুলেছে। ঘটনাচক্রে তারা এখন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য। আর বন্দর যে পরিমাণ পণ্য খালাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পালন করতে না পারাতেই মূল সমস্যা।” শুভেন্দুর দাবি, “আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমেই শ্রমিকরা দাবি আদায় করছেন। ওদের সমস্যা হলে শ্রম কমিশনার, জেলা প্রশাসন কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষ তা মেটাবেন। বন্দরের আধুনিকীকরণেরও বিরোধিতা করা হচ্ছে না।” হলদিয়া বন্দরের সিটু নেতা বিমান মিস্ত্রী বলেন, “লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রাথমিক ভাবে লোক নিয়োগ হলেও পরে তৃণমূল সাংসদই পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাড়তি দেড়শো লোকও ঢুকিয়েছেন। তাতে এবিজে-র লোকসান বাড়ছে। তবে শ্রমিক অসন্তোষের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা।”
এবিজি-র অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষও। বন্দরের চেয়ারম্যান মনীশ জৈন বলেন, “ওদের সঙ্গে কোনও চুক্তির খেলাপ করিনি। চুক্তিতে মাসে ৯ লক্ষ টন পণ্য খালাসের কথা কোথাও লেখা নেই। বরং গত বছর ‘ড্রাই বাল্ক’ পণ্যের ৪০% ওই দুটি বার্থে দেওয়া হয়েছে। ওদের সঙ্গে আলোচনা করেই অবস্থান ঠিক করবে বন্দর।” বন্দরের এক মুখপাত্রের পাল্টা অভিযোগ, “বন্দর-ব্যবহারকারীদের মধ্যে অযথা আতঙ্ক ছড়াতেই এই কৌশল নিয়েছে এবিজি।”

এবিজি গোষ্ঠী
জাহাজ নির্মাণ থেকে পণ্য খালাস বহু কাজই করে সংস্থাটি। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু এই সংস্থা এখন সুরাত, তুতিকোরিন, কান্ডলা, বিশাখাপত্তনম, পারাদ্বীপ ইত্যাদি বন্দর মিলিয়ে বছরে ২৫০ লক্ষ টন পণ্য খালাস করে। বিদেশেও এদের ব্যবসা রয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.