সারের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সোমবার সংসদে ধর্নায় বসতে চলেছে তৃণমূল। আর তাতেই ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে সরকার। তাদের আশঙ্কা, শরিক দলের ধর্নার এই ‘স্ফুলিঙ্গ’ থেকেই কেন্দ্র বিরোধিতার নতুন ‘আগুন’ ছড়াতে পারে।
সারের অপর্যাপ্ত সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে মাত্র কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি দিয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। একই কারণে কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত জেনাকে ফোন করেছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। গত সোমবার দিল্লির যন্তরমন্তরে ধর্নায় বসে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ীও।
অনাবৃষ্টির কারণে এমনিতেই এ বার চাষের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তার উপর সারের দাম বাড়ায় রাজ্যে রাজ্যে শাসক দলের উপর চাপ বাড়ছে। তাই রাজ্যগুলিও কেন্দ্রের কোর্টে বল ঠেলতে চাইছে। এ ব্যাপারে মমতা, নবীন, নীতীশ ও জয়ললিতা তলে তলে যোগাযোগ রাখছেন বলেও মনে করছে কেন্দ্র।
ফলে তৃণমূল ধর্নায় বসলে সর্বভারতীয় এবং আঞ্চলিক প্রায় সব দলই তাদের সমর্থন দেবে বলে ধারণা কেন্দ্রের। অতীতে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বা লোকায়ুক্ত গঠনের প্রশ্নে, একই ভাবে মমতার প্রতিবাদের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে কেন্দ্রকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল বিজেপি, বাম ও আঞ্চলিক দলগুলি।
মনমোহন সরকারের এই আশঙ্কার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন শ্রীকান্ত জেনা। সার ও রসায়ন মন্ত্রী তথা করুণানিধি-পুত্র আলাগিরি কালেভদ্রে দিল্লি আসেন। ফলে সারের দাম বাড়া নিয়ে যাবতীয় অসন্তোষ ও সঙ্কট সামলাতে হচ্ছে প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা শ্রীকান্তকেই। তাঁর কথায়, “সোমবার থেকে সংসদে কয়লার জায়গা সার নিতেই পারে। কেননা সারের দাম বাড়া নিয়ে কৃষক অসন্তোষ বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে।”
শ্রীকান্তের দাবি, “ইউরিয়া সারের সরবরাহ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সরকারের বেঁধে দেওয়া প্রতি মেট্রিক টন ৫৩১০ টাকা দামেই ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে। আসল সমস্যা হয়েছে বিনিয়ন্ত্রণ করা ফসফেট, পটাশ ও যৌগ সারের দাম নিয়ে।” মন্ত্রীর মতে, এই সব সারের দাম বৃদ্ধির একটা কারণ হল, ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়ে যাওয়া। যার ফলে এই সব সারের আমদানি-খরচ এ বছর টন প্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে। তবে একই সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি, “কিন্তু এ-ও দেখা যাচ্ছে যে বিপণন সংস্থাগুলি ইচ্ছামতো খুচরো মূল্য নির্ধারণ করছে। টন প্রতি অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা মুনাফা করতে শুরু করেছে তারা। আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, বিনিয়ন্ত্রণ হলেও, ফসফেট ও পটাশ সারের দামের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। নইলে চাষিদের সঙ্কট বাড়বে।”
এই অভিযোগ খারিজ করে ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল সতীশ চন্দ্র বলেছেন, “বিপণন সংস্থাগুলি ২ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে না। উৎপাদন ও আমদানি খরচের সব হিসেব সরকারের কাছে আছে।”
সারের দাম বাড়ায় সব থেকে অসুবিধা পড়েছেন কৃষকরা। কারণ, কৃষিপণ্যের দাম সে ভাবে বাড়েনি, অথচ খরচ বাড়ছে। মমতার বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা পঞ্জাব বা হরিয়ানার চাষিদের মতো ধনী নন। ফলে এত দাম দিয়ে তাদের পক্ষে সার কেনা সম্ভব হচ্ছে না।” শুধু সারের দাম নয়, পশ্চিমবঙ্গে পটাশ ও ফসফেট সারের চাহিদা অনুযায়ী জোগানোরও অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ। এই অবস্থায় গত মাস দেড়েক ধরেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিকল্পনা করছিলেন মমতা। রাজ্য থেকে কৃষকদের একটি বড় প্রতিনিধি দলকে দিল্লি এনে বিক্ষোভ দেখানোর কথাও ভাবা হয়েছিল এক সময়। আপাতত সোমবার সংসদে তৃণমূল সাংসদদের বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
তৃণমূলের এই আন্দোলনের সঙ্গে রাজ্য-রাজনীতিরও সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অতীতে সারের মূল্য বিনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন বামেরাও। কিন্তু মমতা যে ভাবে এ নিয়ে আন্দোলনে নামছেন, তাতে তারাও চাপে পড়ে গিয়েছে। প্রকাশ কারাট, এ বি বর্ধনরা বুঝতে পারছেন মমতা তাঁদের রাজনৈতিক পরিসরটি দখল করতে চাইছে। কিন্তু বিষয়টি এমনই স্পর্শকাতর যে, তাঁদের পক্ষে সমর্থন জানানো ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামেদের রাজনৈতিক স্থান নিতে চাইছেন ঠিকই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তৃণমূলের অনেক আগে থেকেই সারের দাম বাড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বামেরা। তবে যে হেতু তিনি কৃষক স্বার্থে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন, তাই এ ব্যাপারে তাঁকে বামেরা সমর্থন জানাবে।” একই কথা বলেছেন, বিজেপি-র প্রকাশ জাভড়েকর।
তবে সারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রের বিরোধিতায় বাম, বিজেপি ও আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে তৃণমূলের এককাট্টা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। আর তাতেই চিন্তায় কংগ্রেস।
|
সার-কথা |
সার |
এপ্রিল ২০১০ |
অগস্ট ২০১২ |
ফসফেট |
৯০০০ |
২৪,০০০-২৬,৫০০ |
পটাশ |
৪৫০০ |
১৫,২০০-২৩,১০০ |
দাম টন-প্রতি টাকায় |
আর্থিক দায় কমাতে ২০১০-এর এপ্রিলে ‘পুষ্টিগুণ-নির্ভর ভর্তুকি’ (নিউট্রিয়েন্ট বেসড সাবসিডি) চালু করে কেন্দ্র। অর্থাৎ, পুষ্টিগুণ বিচার করে পটাশ, ফসফেট ও যৌগ সারের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া শুরু হয়। পাশাপাশি ওই সব সারের দামের উপর থেকে তুলে নেওয়া হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ । সরকারের আশা ছিল, এর ফলে প্রতিযোগিতার জেরে সারের দাম কমবে। |
|