তাঁর সেই ‘বিখ্যাত’ রাগী মন্তব্যটা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
স্টিভন পল জোবস তাঁর জীবনীকারকে যা বলেছিলেন, তার সোজাসাপ্টা মানে দাঁড়ায় সাধের যন্ত্রগুলোর ‘টুকলি’ হওয়া আটকাতে তিনি প্রয়োজনে পরমাণু যুদ্ধেও পিছপা হবেন না।
শেষমেশ ‘পরমাণু যুদ্ধ’ হয়তো নয়, কিন্তু শুক্রবার আমেরিকার এক আদালতে জোবস-হীন অ্যাপল যে লড়াইটা জিতে উঠল, তাকে ছোটখাটো বিশ্বযুদ্ধ বললে অত্যুক্তি হয় না। যে লড়াইয়ে ৯ সদস্যের জুরি রায় দিয়েছে আইফোন এবং আইপ্যাডের শুধু বাহ্যিক নকশাই নয়, প্রযুক্তিগত বিশেষ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বেআইনি ভাবে তাদের অধিকাংশ ফোন এবং ট্যাবলেট কম্পিউটারে ব্যবহার করেছে স্যামসাং। সাদা বাংলায়, ‘পেটেন্ট’ নেওয়া কোনও আবিষ্কারকে চুরি করা বলতে যা বোঝায়, এ-ও তাই। অ্যাপলকে ১০৫ কোটি ডলার (৫৮৮০ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ দিতে স্যামসাংকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোন স্যামসাং? যারা কি না গত কয়েক বছর ধরে স্মার্টফোনের ব্যবসায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল স্টিভ জোবসের ‘মানসপুত্র’ আইফোনকে! হিসেব বলছে, সারা দুনিয়ায় স্মার্টফোন যত বিক্রি হয়, তার অর্ধেকই হয় আইফোন, না হলে স্যামসাংয়ের কোনও ‘গ্যালাক্সি ফোন’। এবং গ্যালাক্সি ফোন হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও কতকটা মনে হয়, আইফোনেরই যেন কোনও ‘সরল’ সংস্করণ। টাচ স্ক্রিন ছুঁতেই ফুটে ওঠে আইফোনের মতো সারিবদ্ধ আইকন। এমনকী অনেকের মতে, গ্যালাক্সি ফোনের ব্যবহারই বেশি সুবিধাজনক। ‘মিল’টা আছে ট্যাবলেট কম্পিউটারেও। আইপ্যাড এবং গ্যালাক্সি ট্যাব পাশাপাশি রাখা থাকলে চোখের দেখাতেও মনে হয়, ‘যেন অনেকটা এক রকম।’
আর এখানেই অ্যাপলের আপত্তি। সেই থেকেই শুরু মনোমালিন্য আর মামলা-পাল্টা মামলা। হবে না-ই বা কেন? আইফোন বা আইপ্যাডের আসল চমকটাই তো তার ব্যবহারপদ্ধতিতে। আইফোনে কোনও ছবি ছোট-বড় করার (জুম ইন-জুম আউট) করার কায়দাটা অনবদ্য। টাচ স্ক্রিনে ছবিটার উপরে দু’টো আঙুল ছুঁইয়ে রেখে আঙুল দু’টোকে ক্রমশ ছড়াতে থাকলেই হল। ছবি যাবে বেড়ে। আবার উল্টো পথে দু’আঙুল চালাতেই সে ফের একরত্তি। |
শুধু তা-ই নয়, ধরা যাক কেউ আইফোনে কোনও তালিকা বা লেখা পড়ছেন। লেখাটার একদম শেষে পৌঁছে যাওয়ার পরেও যদি আঙুল চালিয়ে সেটাকে আরও ওপরে তোলার চেষ্টা করা হয়, পাতাটা ততই স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে ছিটকে নীচে নেমে আসে। যাকে পরিভাষায় বলে ‘বাউন্স ব্যাক’। এমন দু’টো চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যই স্যামসাং তাদের স্মার্টফোনে বেমালুম ‘টুকে দিয়েছে’ বলে মনে করে ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসের ওই আদালত। তা ছাড়া, আইফোনের আকৃতি, গড়ন এই সমস্তও রয়েছে ‘নকলের’ তালিকায়।
স্যামসাং অবশ্য বলছে, তারা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবে। অ্যাপলও এখানেই যুদ্ধে ইতি টানছে না। তাদের ভাবনায় রয়েছে, আইনি পথে স্যামসাংকে আমেরিকার বাজার থেকে জনপ্রিয়তম সমস্ত মোবাইল এবং ট্যাবলেট তুলে নিতে বাধ্য করা। ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা তিন গুণ বাড়ানোর আর্জি জানানোর কথাও ভাবা হচ্ছে। এই মামলায় অ্যাপল প্রথমে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল ২৫০ কোটি ডলার। স্যামসাংয়ের প্রায় দু’ডজন পণ্য ছিল তাদের সন্দেহ-তালিকায়। শেষ পর্যন্ত অ্যাপলের কিছু অভিযোগ বাতিল হওয়ায় সেই অঙ্কটা কমে। উল্টো দিকে, স্যামসাংও অ্যাপলের কাছ থেকে প্রায় ৪০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, অ্যাপলের অনেক যন্ত্রপাতি ‘সোনি’র মতো সংস্থার থেকে অনুপ্রাণিত। ‘অ্যাপল দুর্দান্ত যন্ত্র বানায় ঠিকই, কিন্তু ‘ভোঁতা কোণওয়ালা আয়তাকার ফোন বানানোর একচেটিয়া অধিকার তাদেরই রয়েছে, এ কথা কে বলল?’ এই ছিল স্যামসাংয়ের যুক্তি। তাতে অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। এক ডলারও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না স্যামসাং।
এই আইনি যুদ্ধের পথ ধরেই আসছে এক অন্য ধরনের জটিলতার আশঙ্কা। সেটা মোবাইলের গড়ন বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে নয়, অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে। স্যামসাংয়ের মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেম হল ‘অ্যান্ড্রয়েড’। জোবসের ‘পরমাণু যুদ্ধে’র হুমকি ছিল অ্যান্ড্রয়েড, তথা তার নির্মাতা গুগলের উদ্দেশে। জোবস মনে করতেন, অ্যান্ড্রয়েড আসলে আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমেরই নকল। আর এই অ্যান্ড্রয়েড শুধু দক্ষিণ কোরিয়াজাত স্যামসাং নয়, তাইওয়ানের ‘এইচটিসি’-সহ আরও বেশ কিছু সংস্থার মোবাইলেরও অপারেটিং সিস্টেম। কাজেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বার হয়তো এই সংস্থাগুলো আইনি জটিলতার ভয়ে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করতেই চাইবে না। গ্রাহকদের পছন্দসই কিছু ‘ফিচার’ হয়তো বন্ধই করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে স্যামসাং তাদের যন্ত্রপাতির দাম বাড়িয়েও দিতে পারে।
অনেকে অবশ্য বলছেন, অ্যাপল বা স্যামসাংয়ের মতো সংস্থার কাছে এই টাকার অঙ্কটা এমন কিছু নয়। আসল প্রশ্ন হল ভাবমূর্তি। সব সংস্থাই চায় উদ্ভাবক হিসেবে বিখ্যাত হতে, ‘চোর’ বলে নয়। মজার ব্যাপার হল, এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার আদালত দুই সংস্থাকেই পরস্পরের পেটেন্ট চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। উপরন্তু বলেছিল, স্যামসাংয়ের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি বেআইনি ভাবে ব্যবহার করেছে অ্যাপল।
এ বার ‘ঘরের মাঠে’ পাল্টা জয় ছিনিয়ে আনল অ্যাপল। যাকে কটাক্ষ করে স্যামসাংয়ের বিবৃতি “এই রায়কে অ্যাপলের জয় নয়, বরং মার্কিন উপভোক্তাদের পরাজয় হিসেবেই দেখা উচিত। কারণ এর পর তাঁরা নতুন বলতে আর কিছু পাবেন না। পড়ে থাকবে হাতে গোনা কিছু দামি পণ্য!” |