খড়্গপুরের ছোট্ট তুহিন মহাকাশবিজ্ঞানী হতে চায়। হোক না গোটা দেহটাই অকেজো, অসাড়। মুখ আর মাথাটুকুর উপরে তো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁকে ধরে রাখা পেন। ঝড়ের গতিতে অঙ্ক কষা হয়ে যাচ্ছে। ইংরেজি, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ঠোঁট দিয়ে পাতা উল্টে খসখস লেখা চলছে। ক্লাসে সবার আগে উত্তর লেখা শেষ। বাদ বাকি ‘সুস্থ’ সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনা করেই এখনও পর্যন্ত এক বারের জন্যও ‘সেকেন্ড’ হয়নি তুহিন দে। খড়্গপুরের সেন্ট অ্যান্টনিজ স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান তার বাঁধা। শিক্ষকদের চোখে ‘হীরের টুকরো’। ক্লাসের ‘মনিটর’। কম্পিউটর, সাধারণ জ্ঞান, বিতর্কে তুখোড়। ঠোঁট দিয়েই মোবাইল ফোন চালায় অসম্ভব ক্ষিপ্রতায়। বিশেষ প্রতিভার জন্য রাজ্যপালের দেওয়া পুরস্কার পেয়েছে এ বছরই। নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার নিতে দিল্লি যাচ্ছে স্টিফেন হকিংয়ের ভক্তটি।
প্রচলিত সমাজ আর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী মাত্রেই তাকে ‘স্পেশ্যাল স্কুল’-এর দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। নিয়ম থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষ এদের ভর্তি নিতে চান না। কিন্তু তুহিন প্রমাণ করে দিয়েছে, সুযোগ পেলে তারা সমানে সমানে লড়তে পারে। হাত দিয়ে পেন ধরে সহপাঠীরা যে দ্রুততায় লেখে, তাকে হারিয়ে দিচ্ছে তুহিনের দাঁতে ধরা কলম। তাঁর শিক্ষক টি মহেশ রাও বলছেন, “তুহিনের মতো মেধাবী ছাত্র খুব কমই দেখেছি। মুখ দিয়ে এত তাড়াতাড়ি লেখে, আমরা অবাক হয়ে যাই।” কে শেখাল তুহিনকে? মা বললেন, “ও নিজেই শিখেছে। এক দিন শ্লেট-পেনসিল নিয়ে ওর জন্য আঁকিবুঁকি কাটছিলাম। ও হঠাৎ মুখে করে চকটা নিয়ে নিজেই আঁকতে শুরু করল।”
কী করে সম্ভব হচ্ছে এটা? প্রেসিডেন্সি কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রধান দেবাশিস সেন জানাচ্ছেন, “শরীরের এক-একটি অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ বরাদ্দ আছে। হাত-পা যদি অকেজো হয়, তাহলে তার জন্য বরাদ্দ প্রকোষ্ঠ অন্য অঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। তখন অন্য অঙ্গটি অনেক বেশি সচল হয়ে ওঠে।” তুহিনের ক্ষেত্রে তার ঠোঁট-দাঁত এই ভাবেই বাকিদের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। কারণ তার হাত-পা প্রায় সম্পূর্ণই নিষ্ক্রিয়। কেন?
মস্তিষ্কে বিরল রোগ ‘আর্থ্রোগ্রাইপোসিস মাল্টিপ্লেক্স কনজেনিটা’-য় জন্ম থেকে আক্রান্ত তুহিন। পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জন নিলয় দাসের কথায়, এই রোগে জন্ম থেকেই শিশুর হাত-পায়ের সংযোগস্থল ও মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাংসপেশি খুব দুর্বল হয়। হাত-পা পুরোপুরি বেঁকে থাকে। নিলয়বাবু বলেন, “এ রোগের কারণ এখনও অজানা। তবে মনে করা হয়, মায়ের গর্ভে ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় মাংসপেশি এবং স্নায়ুর স্বাভাবিক গঠন বাধা পেলে এমন হয়।” প্রায় ১৬০ ধরনের আর্থ্রোগ্রাইপোসিস মাল্টিপ্লেক্স কনজেনিটা এখনও পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে। এই রোগ পুরোপুরি সারে না। তবে জন্মের পর থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শিশুর হাত-পায়ের স্ট্রেচিং, ফিজিওথেরাপি করলে কিছুটা কাজ হয়। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষের কথায়, “এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্ক একেবারে স্বাভাবিক হয় বলেই তাদের মানসিক যন্ত্রণা অনেক বেশি। আমার কাছে এই মুহূর্তে এই রোগে আক্রান্ত কয়েক জনের চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে লেক গার্ডেন্সের একটি শিশুর ফিজিওথেরাপি করে শারীরিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।”
তুহিনের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল জন্মের দু’দিন পর থেকেই। এখনও পর্যন্ত ভেলোর-কলকাতা মিলিয়ে শরীরে ২৪ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। তার পরেও অনেক কষ্টে উপুড় হওয়া আর সোজা হওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারে না তুহিন। কোলে করে মোটরবাইকে বসিয়ে নিয়ে যেতে হয় স্কুলে। ক্লাসে কোনও রকমে বেঞ্চে বসতে পারে। ব্যাগ থেকে বই বার করে দেওয়া, টিফিন খাওয়ানো সব করে দেয় সহপাঠীরা। রোজ ফিজিওথেরাপি আর অকুপ্রেসার থেরাপি তো আছেই।
খড়্গপুরে মালঞ্চ রোডের বাড়িতে বসেই তুহিনের মা সুজাতা দে ও বাবা সমীরণ দে জানান, জন্মের সময় নার্সরা ভেবেছিলেন, বাচ্চাটার হাতটা বোধহয় কোনও ভাবে বেঁকে রয়েছে। সোজা করার চেষ্টা করতে গিয়ে সদ্যোজাতের বাঁ হাতটা ভেঙেই গিয়েছিল। যুদ্ধের শুরু সেই প্রথম দিনই।
যুদ্ধের ১২ বছরের নায়ক কিন্তু অকুতোভয়। অসহায়তার কথা শুনলে ফুঁসে ওঠে বলে, “পড়াশোনা করছি, গল্পের বই পড়ছি, দেশ-বিদেশের কথা জানছি, খেলা দেখছি, সিনেমা দেখছি, গান শুনছি— অসুবিধাটা কোথায় আমার?” বলে চলে, “হেলেন কেলার বাঁচেননি? কিংবা স্টিফেন হকিং? অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সিডনি অলিম্পিকে দৌড়েছিলেন আমেরিকার মার্লা রুনিয়ান। আসল হল মনের জোর।”
এই মনের জোরেই আর্থ্রোগ্রাইপোসিস-আক্রান্ত আমেরিকার সানি টেইলর নামী চিত্রকর হয়েছেন। তুহিনের মতোই মুখ দিয়ে ছবি আঁকেন তিনি। নতুন নতুন ভিডিও গেমের আবিষ্কর্তা হিসাবে বিখ্যাত হয়েছেন র্যান্ডি ফিটজেরাল্ড। তাঁরও আর্থ্রোগ্রাইপোসিস। ‘লিয়ানা’ নামে জিম্বাবোয়ের একটি মিউজিক ব্যান্ডের প্রধান গায়ক প্রুডেন্স মাভেনা। তাঁরও একই অসুখ।
তুহিনও এগিয়ে যাচ্ছে। নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সমস্ত সঞ্চয় উপুড় করে দিয়েছেন জমি-বাড়ির ব্যবসায় যুক্ত বাবা। তুহিনকে মনোবল জোগানোর প্রধান দুই স্তম্ভ তুহিনের বাবা-মাই। কৃত্রিম পায়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরোনো সাঁতারু মাসুদুর রহমান বৈদ্য তুহিনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলছেন, “তুহিনকে যদি আমরা সব রকম সাহায্য করতে পারি,
কে বলতে পারে আমরাও এক জন স্টিফেন হকিংকে পাব না?” |