প্রথম ভারতীয় হিসেবে কোনও গল্ফ টুর্নামেন্টের মেজরে ‘হোল ইন ওয়ান’ করে দেখানোর বিরল কৃতিত্ব তাঁর পকেটে। বয়স মাত্র ২৫। ব্রিটিশ ওপেনে সাড়া ফেলে দিয়ে ৩১ নম্বর হওয়া বেঙ্গালুরু প্রবাসী বঙ্গসন্তানের এখন দুটো স্বপ্ন। ২০১৬-র অলিম্পিকে কোনও পদক। এবং কোনও মেজর জিতে ইতিহাস সৃষ্টি।
কথায় কথায় বলেন, ‘কিপ থিংস সিম্পল।’ বেঙ্গালুরুর ফ্ল্যাটে একা থাকেন, চা থেকে চাউমিন, সব বানাতে পারেন। খেতে ভালবাসেন মা-র হাতের পটলের দোর্মা। বাবা সেনাবাহিনীর ডাক্তার বলে ছোটবেলা থেকে জীবন কেটেছে ভারতের বিভিন্ন শহরে। কখনও রুরকি, কখনও জয়পুর, কখনও চন্ডিগড়, কখনও হায়দরাবাদ। এখন বাবা-মা হায়দরাবাদে থাকলেও স্রেফ গল্ফের জন্য একা বেঙ্গালুরুতে। “আরে আসুন না একবার বেঙ্গালুরুতে। আমার অ্যাপার্টমেন্টে আমি সব কিছু একাই করি। প্রচুর বন্ধু, বান্ধবী আছে। কেউ কেউ আমার মতোই পেশাদার গল্ফ খেলে। আবার কেউ কেউ শুধুই বন্ধু। অবসর সময়ে আমরা দল বেঁধে কখনও উটিতে লং ড্রাইভে চলে যাই। কখনও বা হিমালয়ে বেড়াতে যাই। কোনও চাপ নেই জীবনে। একটাই মোটো। কিপ থিংস সিম্পল,” ফোনে আড্ডা দিতে দিতে বলছিলেন অনির্বাণ।
এই সেই বঙ্গসন্তান, যিনি ব্রিটিশ ওপেনে আলাদা করে চোখ টেনে নিয়েছেন। যাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। কথাবার্তায় ক্রিকেটারসুলভ হামবড়া ভাব নেই, বরং একেবারে সাদাসিধে পাশের বাড়ির ছেলে। বলছিলেন, “গল্ফটা একটা অদ্ভুত খেলা। কারণ এই খেলায় আপনার পারফরম্যান্স প্রতিপক্ষের ভুলের উপর নির্ভর করে না। আপনি নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা। এই জন্যই গল্ফকে বলে ‘লোনলি স্পোটর্’। এই খেলায় আপনি সব সময় নিঃসঙ্গ, লড়ছেন নিজের সঙ্গে। নিজের সঙ্গে লড়াটা আমার ভীষণ আকর্ষণীয় লাগে।”
যে কোনও ক্রীড়াবিদ একটা বড় স্বপ্ন সামনে রেখে এগোয়। কোনও ভারতীয় গল্ফার আজ পর্যন্ত কোনও মেজর জেতেননি। জীব মিলখা সিংহদের জমানায় যে সেই স্বপ্নটা দেখা শুরু হয়েছে, মানছেন অনির্বাণ। “ভারতীয় গল্ফ কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন বেশ ভাল একটা জায়গায়। জীবের কথা বলছেনজীব খুব বড় গল্ফার। ভারতীয়দের মধ্যে আমার আইডল। এ ছাড়া অর্জুন অটওয়াল আছে, জ্যোতি রণধাওয়া আর রাহিল গাঞ্জি আছে। বিশ্বসেরাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। যদিও গল্ফে কিছুই বলা যায় না। এখানে একটা সপ্তাহ আপনার দুর্দান্ত গেলে পরের সাতটা সপ্তাহ খুব খারাপ যেতে পারে। ব্রিটিশ ওপেনে আমার ‘হোল ইন ওয়ান’-টাই ধরুন। আমি কিন্তু মনে করি ওটা অনেকটাই লাক। হয়ে গিয়েছে।” |
ভারতের তরুণ প্রজন্মের গল্ফারদের মধ্যে সেরা সম্ভাবনা ধরা হচ্ছে অনির্বাণকে। ইন্দ্রজিৎ ভালোটিয়ার মতো গল্ফার যেমন বলছেন, “ভীষণ পরিশ্রমী ছেলে অনির্বাণ। মাথাটা অসম্ভব ঠান্ডা। সব ঠিকঠাক চললে বছরখানেকের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ষাটে চলে আসতে পারে।” যেটা বলতেই বিনয়ী ও সংযত অনির্বাণ। “স্বপ্ন তো দেখিই। প্রশংসা শুনতেও ভাল লাগে। আমি ভাবতে চাই ব্রিটিশ ওপেনটা সবে শুরু। বড় কিছু করার খিদে না থাকলে পেশাদার ক্রীড়াবিদ কখনওই সামনের দিকে এগোতে পারে না। খিদেটাই তো আসল। টাইগার উডসকে কাছ থেকে দেখছিলাম ব্রিটিশ ওপেনে। আমার বরাবরের হিরো। ব্যক্তিগত জীবনে স্ক্যান্ডাল নিয়ে কত কী ঘটে গিয়েছে। তবু লোকটার রেজাল্টটা দেখুন। গল্ফে ফিরে আসার পরে আটটা টুর্নামেন্ট খেলে তিনটেতে জিতেছে। গল্ফে যেটা অভাবনীয়।” উডস ছাড়া অন্য হিরো নেই? গল্ফ বা অন্য কোনও খেলায়? “অল টাইম হিরো বললে ল্যান্স আর্মস্ট্রং। ক্যান্সার থেকে ফিরে এসে আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া শুধু নয়। লোকটার জীবন পড়লে অবিশ্বাস্য মনের জোর পাওয়া যায়। সাইক্লিং কিন্তু খুব ফিজিক্যাল একটা খেলা। অসম্ভব স্ট্যামিনার দরকার হয়। আর্মস্ট্রংয়ের লেখা ‘ইটস নট অ্যাবাউট দ্য বাইক’ বইটা আমি প্রায়ই পড়ি। নিজেকে মোটিভেট করতে পারি,” বলছিলেন অনির্বাণ।
দ্রাবিড়ের শহরের ছেলের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসে দ্রাবিড়সুলভ মানসিকতা। আলাপ আছে কিনা বলতেই হাসি, “ক্রিকেটারদের মধ্যে আমার দ্রাবিড়কেই ভাল লাগে। কী ডেডিকেশন! বছর দুয়েক আগে আমাদের বেঙ্গালুরুতে ঈগলটন গল্ফ কোর্সে একবার ভারতীয় দল এসেছিল গল্ফ খেলতে। তখনই দ্রাবিড়ের সঙ্গে আলাপ হয়। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দীর্ঘ সময় মনোসংযোগ ও একাগ্রতা ঠিক রাখতে হলে কী করতে হবে। খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন মানসিক কাঠিন্য বাড়ানোর কয়েকটা উপায়। কয়েকটা এক্সারসাইজ। মনকে ঠিক রাখতে এর চেয়ে ভাল দাওয়াই হয় না।”
মেডিটেশনের কথা যখন এলই, ব্রিটিশ মিডিয়াকে তো আপনি বলেছেন ‘মেডিটেশন ইজ দ্য কি!’ একটু ব্যাখ্যা করবেন? “আমি তো বলব মেডিটেশন শুধু গল্ফ নয়, আমার জীবনটাকেই বদলে দিয়েছে। দিনে কুড়িটা মিনিট দিই। একটা ইন্সটিটিউট থেকে কোর্স করে এসেছি। জীবনটাকে এখন খুব সহজ করে দেখতে পারি,” ব্যাখ্যা অনির্বাণের। কোনও দিন গল্ফের মেজর জিতুন বা না জিতুন, এই বঙ্গসন্তানের চোখে স্বপ্ন রয়েছে, প্রত্যয় রয়েছে। সঙ্গে পরিশ্রম করার ক্ষমতা। আর কী চাই? |