তিনি ভাল নাচেন। হাতে ট্যাটু করান। নিয়মিত চুলের স্টাইল পাল্টান। রাতারাতি বদলে যায় তাঁর মোবাইলের ‘কলারটিউন।’ প্রেমিকার সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফেসবুক স্ট্যাটাস পাল্টে হয়ে যায় ‘সিঙ্গল’। মিটমাট হলেই আবার ইন্টারভিউ দিয়ে বলেন, ‘‘এ বছরই আমরা বিয়ে করছি।”
বিদেশ সফরে গেলে ফাঁক পেলেই ঘুরে দেখেন সেখানকার শপিং মল। পছন্দ করেন বিদেশি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, জামাকাপড়। ডিজেলের জিন্সই আছে পনেরোটার বেশি! ক্রিকেটের পাশাপশি ভালবাসেন সিনেমা। দাদা ফিল্ম প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত বলেই হয়তো ভেবে নিতে অসুবিধে হয় না ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পরে নিজের জীবন নিয়ে কী করবেন। “অভিনয় করার শখ আছে অনেক দিনের। দেখা যাক সেটা হয় কিনা।”
তাঁর মধ্যে আবার চোয়ালচাপা একটা সঙ্কল্পও থাকে। বন্ধু ক্রিকেটার বাদ পড়লে নির্বাচকদের তুলোধোনা করতে দু’বার ভাবেন না। বিতর্কে ঢুকে পড়েন অনায়াসে। গরমাগরম ‘কোট’ দেওয়ার পরের নিশ্বাসেই বলে দেন, “নো কন্ট্রোভার্সি প্লিজ!” আবার সযত্নে প্রচারের আলো এড়িয়ে ছোট্ট একটা ছেলের ক্রিকেট কোচিংয়ের সব ভার তুলে নেন নিজের কাঁধে। কেন, না সেই ছেলের বাবার সঙ্গে তাঁর পুরনো আলাপযখন তিনি নিজে তারকা হয়ে ওঠেননি। যখন তিনি নিয়মিত কিটব্যাগ কাঁধে লঞ্চে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া থেকে কলকাতা আসতেন ক্রিকেট-সাধনার যাত্রায়।
হ্যাঁ, তিনি ক্রিকেটটাও খেলেন। ব্যাট তাঁর ভালই চলে, বোলিংও ইদানীং মন্দ নয়।
সত্তর দশকের ছ’ফুটের ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’-কে মনে পড়ছে? ইনিও ‘অ্যাংরি’। ‘ইয়াং’-ও বটে। কিন্তু ওই দুটো শব্দে তাঁর ব্যক্তিত্বের পুরোটা ধরা যাবে না। বরং অনেক বেশি করে বলতে হবে, ইনি ‘জেন ওয়াই’-এর মুখ। যাঁকে কলার তুলে মাঠে এগোতে দেখলে, ডোয়েন ব্র্যাভোকে আইপিএল ফাইনালের শেষ ওভারে মেরে পাট করে কাপ জেতাতে দেখলে বাঙালির আজ মনে হয়, ‘বাহ্, বেড়ে খেলল তো ছেলেটা!’ আন্তর্জাতিক ম্যাচে সেঞ্চুরি করলে বাঙালি বলতে পারে, “যাক, শুধু সৌরভেই তা হলে সব শেষ নয় আমাদের।”
নামটা যে মনোজ তিওয়ারি, এর পরেও বলে দিতে হবে? আইপিএল ফাইভের স্মৃতি তো এখনও কলকাতার মনে বাসি হয়ে যায়নি।
ক্রিকেট মাঠে বাঙালির হুঙ্কার বলতে এত দিন একটাই ছবি বোঝাত। লর্ডসের ব্যালকনিতে বন-বন করে জামা ঘোরাচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ব্রিটিশদের মুখ চুন। সৌরভ ট্যাটুও করাননি, ডোনার সঙ্গে সম্পর্ককে তুলে আনেননি ফেসবুকে। ফেসবুক প্রোফাইলই নেই তাঁর। |
কিন্তু সে সব ছবি এখন অ্যালবামের পাতায় চলে গিয়েছে। পরম মমতায় সেই অ্যালবামের পাতা এখনও উল্টে দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে ক্রিকেটপাগল বাঙালি খুঁজে নিয়েছে তার নতুন পোস্টার বয়। যাঁকে দেখে জেন-ওয়াই বাঙালি বলতে পারে, আরে এই তো আমাদের বিরাট কোহলি! আইপিএল মরসুমে তাই ইডেনের গ্যালারির এ দিক-ও দিক চোখ ফেরালেই দেখা যায় মনোজের ন’নম্বর জার্সি পরা তরুণীর ঝাঁক।
অথচ সৌরভ আর মনোজের বেড়ে ওঠায় কত তফাত! হাওড়ার রেলওয়ে কলোনির ছোট্ট কোয়ার্টারে কোনও মতে থাকতেন মনোজের পরিবারের পাঁচ সদস্য। তিন ছেলেকে খাটে শুতে দিয়ে বাবা-মা শুতেন মেঝেয় বিছানা পেতে। বাবার মাইনে ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এমনও দিন গিয়েছে, যে দিন তিন ছেলেকে ভরপেট খেতে দিতে পারতেন না মনোজের মা। “টাকা ধার করে, অনেক কষ্ট করে আমাদের তিনজনকেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছিলেন বাবা।” কলোনির মাঠেই চুটিয়ে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলতেন ছোট্ট মনোজ। সেখান থেকে স্কুল ক্রিকেট টিমে সুযোগ, কোচের চোখে পড়া এবং মানবেন্দ্র ঘোষের কোচিং সেন্টারে ভর্তি। তার পরের গল্প বোধহয় বাঙালির আর জানতে বাকি নেই।
ছোটবেলার দারিদ্র, দৈনন্দিন টানাপোড়েনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকাটাই বোধহয় ‘রুক্ষতা’ শব্দটা তেইশ বছরের ‘মান্নি’-র চরিত্রের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। ময়দান সেই ধারণা থেকেই বলে, ‘ছোটবেলা থেকে লড়ছে তো, বুকের খাঁচাটা তাই বড়।’ সেটা সত্যিই যে বড়, তা ধোনির স্বজনপোষণের গণ্ডি টপকে তাঁর পারফরম্যান্সে প্রমাণ। বেশি দূর নয়, সদ্য শেষ হওয়া শ্রীলঙ্কা সফর। মনোজ করেন ব্যাটিং, হাতে দেওয়া হল বল। নিট রেজাল্ট? চার-চারটে উইকেট! মনোজের মা বলেছেন, ধোনি পরীক্ষা নিচ্ছিল। কিন্তু মনোজ বলবেন, “ওটা চেন্নাই থেকে ফ্লাইটে ওঠার সময়ই ধোনি বলে দিয়েছিল।”
ক্রিকেটজীবনে বারবার ঠেকে শেখা সাতাশের মনোজ জানেন, ক্রিকেটের এই কঠিন দুনিয়ায় মান-অভিমানের জায়গা নেই। লাভ নেই মুখ খুলে বোমা ফাটিয়ে। তিনি এখন অপেক্ষা করতে শিখেছেন। বুঝেছেন, বিতর্ক তৈরি করে লাভ হয় না। তাতে জনতার সঙ্গে দূরত্বটাই শুধু বাড়ে। তাতে প্রশংসার চেয়ে বেশি সমালোচনা জোটে। বরং ভাঙা মনকে বোঝানো ভাল। ব্যাট হাতে অপেক্ষা করা ভাল। কথা যা বলার সে তো ওই ব্যাটটাই বলবে। আগ্রাসী মনটাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছেন।
ধ্যান করাটা আয়ত্ত করতে পারেননি তো কী, তিনি নিজেই নিজের ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট’ কোচ। |