দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে
আসেননি।
অথচ, তাঁরা
গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক
মানচিত্রকে
রঙিন করে তুলেছেন।
মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
বীর হাম্বীর থেকে চৈতন্য সিংহ, মল্লরাজাদের সাত জন শাসকের শ’দেড়েক বছরের শাসনকাল। তথ্যে মতান্তর থাকলেও বীর হাম্বিরের শাসনকাল শেষ হচ্ছে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে এবং শেষ রাজা চৈতন্য সিংহের শাসনকাল শেষ হচ্ছে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে। মল্লরাজ-বংশ যদিও খুব পুরোনো নয়, তবুও আঞ্চলিক রাজ পরিবারটির গুরুত্ব আছে। তা হল, বীর হাম্বিরের সময় বৃন্দাবন থেকে অমূল্য বৈষ্ণবগ্রন্থ নিয়ে আসছিলেন শ্রীনিবাস আচার্য এবং তাঁর সঙ্গীরা। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এই গ্রন্থ ভর্তি গাড়িটি ডাকাতি হয়। এর পর তা উদ্ধার এবং মল্লরাজদের বৈষ্ণব ধর্মগ্রহণ। এর সঙ্গে জুড়ে আছে আজকের বিষ্ণুপুরের বহু মন্দির নির্মাণ এবং মন্দিরের গায়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলা প্রচার। বিখ্যাত হয়ে যান রাঢ় বাংলার মল্লরাজ পরিবার। ফলে, পরবর্তী কালে একাধিক ঐতিহাসিকের কাছে গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে এই মল্লভূমি।
স্বাভাবিক কারণে গৌরপদ সেনের আগ্রহ তৈরি হয় এই মল্লভূমের ইতিহাসে। অবশ্য ইনি বাঁকুড়া জেলার ভূমিপুত্র। জন্ম বড়জোড়া থানার মালিয়াড়া গ্রামে, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। মালিয়াড়া গ্রামে স্কুলের পাঠ সেরে বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজে। এর পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস পাঠ। নানা কলেজে কর্মজীবন শুরু করে শেষ অবধি নিজের কলেজ, রামানন্দে অধ্যাপনা। বরাবর ছাত্র হিসেবে ভাল ফল করতেন।
“বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় আমাকে ইতিহাসের গবেষক হিসেবে তৈরি করে দেন অধ্যাপক ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়। ওই সময় আমার গবেষণার বিষয় ছিল নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকার ইতিহাসের অর্থনৈতিক দিক। সময়কাল, খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে অষ্টম শতক। বিশেষ ভূমিকা ছিল তাম্রলিপ্ত। এই দিয়েই গবেষক রূপে হাতেখড়ি বলতে পারেন। পরে এর পরিধি বেড়েছে।” বললেন অধ্যাপক গৌরপদ। গবেষকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গবেষণা কাজটুকু করে সামাজিক কাজ শেষ করেন। তাঁদের জটিল-কঠিন গবেষণা খুব কম ক্ষেত্রে সহজপাঠ হয়ে ওঠে আমজনতার। অথচ গবেষণাপত্র যদি গবেষকদের বৈঠকখানা থেকে সরলভাষ্যে সাধারণ পাঠকের কাছে না আসে তবে এক ধরনের ‘দূরত্ব’ থেকে যায়। প্রথমত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র ইংরেজিতে। অবশ্য গৌরপদ সেন ‘ড.’ উপাধিধারী হয়েও সহজ বাংলায় মল্লভূম সম্পর্কে একটি সুন্দর গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। মাত্র এক বছর আগেই প্রকাশ পেয়েছে মল্লভূম : জীবন প্রভাত ও জীবনসন্ধ্যা। কিন্তু বাকি কাজ?
“ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় যা প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে, এখন অবসর কাটছে তাই সম্পাদন করতে। সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবে সহজ ভাষায় এবং ইতিহাস মিশিয়ে লেখা চলছে। তবে, জানেন তো এই সব গ্রন্থের পাঠক সীমিত। প্রকাশকদের দরজাও আরও কম উন্মুক্ত। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েই করতে হবে।” বললেন অধ্যাপক।
এমন করেই আঞ্চলিক ভূমিপুত্ররা তাঁদের অঞ্চলের ইতিহাস লিখে, যাঁরা সামান্যতম ঋণ শোধ করেন, গৌরপদ সেন তাঁদেরই একজন। |