|
|
|
|
জলাভাবে পাট পচানো শিকেয়, বিপাকে চাষিরা |
মিলন দত্ত • কলকাতা |
যথেষ্ট বৃষ্টি নেই তাই পাট চাষ করে বিপদে পড়েছেন চাষিরা। বিপদ কেবল চাষিদের নয়, পাটের উৎপাদন কমলে বিপদ সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের পাট শিল্পের। কারণ, পাট রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসল।
রাজ্যে সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন করে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ। গত তিন মাসে ওই দু’জেলা এবং আর এক পাট উৎপাদনকারী জেলা মালদহে বৃষ্টি এত কম হয়েছে, যে সেখানকার খাল-বিল-পুকুর, বিশেষত নয়ানজুলিতে জল নেই। চাষিরা পাট পচাতে পারছেন না। জলের ব্যবস্থা করতে না পারায় অনেকে পাট কাটতেই পারেননি। আবার
অনেক জায়গায় বিপুল খরচে চাষ করা পাট জমিতেই শুকোচ্ছে। নদিয়ায় গরিবপুর গ্রামের ভক্তরাম ঘোষ জানালেন, জেলার চাপড়া, তেহট্ট, করিমপুর, নাকাশিপাড়া এবং কালীগঞ্জ ব্লকের গ্রামগুলির ৯০ শতাংশ জমিতেই পাট চাষ হয়। ওই পাট সাধারণত রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে পচানো হয়। কিন্তু এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় কোথাও নয়ানজুলিতে জল নেই।
রাজ্যে এ বার বৃষ্টিপাতের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। মালদহ, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদে সেই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। শুক্রবার পর্যন্ত নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং মালদহে শুধু অগস্ট মাসের নিরিখেই ঘাটতি রয়েছে যথাক্রমে ২৫, ৩৫ এবং ৩৭ শতাংশ। নদিয়ায় জুলাইতে অপেক্ষাকৃত ভাল বৃষ্টি হলেও জলের এত অভাব কেন? রাজ্যের কৃষি আবহবিদ দিলীপ দাস বলেন, “ওই তিন জেলাতে জুন মাসে যে বিপুল ঘাটতি ছিল সেটাই সব হিসেব ওলটপালট করে দিয়েছে।” ইদানীং মাঝেমাঝে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু শুকনো মাটি সে জল শুষে নিচ্ছে নিমেষে। জল জমার সুযোগই পাচ্ছে না।
মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি ঘুরে দেখে রাজ্য কৃষি দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা (পাট) রামপ্রসাদ ঘোষের বক্তব্য, “এখনই একটানা ভারী বৃষ্টি না হলে কিংবা পাট পচানোর মতো জলের ব্যবস্থা না করতে পারলে চাষিরা বড় বিপদের মুখে পড়বেন।” সার, বীজ, চাষ এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি মিলিয়ে পাট চাষের খরচ এখন বিঘা প্রতি অন্তত ৮ হাজার টাকা। পাট পচাতে না পারলে সে খরচ কী ভাবে তুলবেন তা নিয়ে চিন্তিত পাট-চাষিরা। নদিয়ার বারুইপাড়া গ্রামের সফিকুল শেখের দাবি, পাট পচাতে না পারলে বোনার
পুরো খরচটাই লোকসান হবে চাষির। তাঁর কথায়, “জল পাই বা না পাই, পাট তো কাটতেই হবে। কারণ, ওই জমিতে পাট কেটে অন্য কোনও ফসল বুনতে হবে। যত দিন তা
না করতে পারছি, পাটের লোকসান মেটানোর বিকল্প
পথও পাব না।” |
|
ছবি: কল্লোল প্রামাণিক |
এই সুযোগে অনেকেই পাট পচানোর জন্য পুকুর ভাড়া দিচ্ছেন। এক বিঘা জমির পাট পচানোর জন্য জলের ভাড়া বাবদ ৬০০ টাকা দিতে হচ্ছে পুকুরের মালিককে। সেটা অবশ্য সমস্যার সমাধান নয়। কারণ, বিপুল পরিমাণ পাট পচানোর মতো পুকুরও সব গ্রামে থাকে না। আর পাট পচানোর ফলে পুকুরের জল পচে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এই অবস্থায় পাটের উৎপাদন যে খানিকটা মার খাবে, তা মেনে নিয়েছেন রাজ্যের এক কৃষি-কর্তা।
২০১০-এ প্রায় খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, সে বার পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজ্য সেচ দফতর মাটির নীচ থেকে জল তুলে বিভিন্ন এলাকায় পুকুর এবং নয়ানজুলিগুলো ভর্তি করে দিয়েছিল। রামপ্রসাদবাবুর আশ্বাস, এ বারও তাই করা হবে। এ
ব্যাপারে মহাকরণে সচিব স্তরের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই জেলা এবং ব্লক স্তরে পৌঁছেছে। কিন্তু চাষিদের একাংশের বক্তব্য, ওই সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হয়ে গিয়েছে। পাট সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে কেটে পচাতে দেওয়ার কথা। কিন্তু ওই তিন জেলায় ইতিমধ্যেই ১২০ থেকে ১২৫ দিন পাট রয়েছে জমিতে। এর পরে পাট কেটে, ধান বোনার সময় থাকবে না।
অথচ, নামমাত্র জল ব্যবহার করে পাট পচিয়ে ঘরে তোলার কারিগরি রয়েছে সরকারেরই হাতে।
কাঁচা পাটের ছাল যন্ত্রে ছাড়িয়ে নামমাত্র জলে রাসায়নিক মিশিয়ে তা পচিয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে পাট ঘরে তোলার এই কারিগরি ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব রিসার্চ অন জুট অ্যান্ড অ্যালায়েড ফাইবার টেকনোলজি’ (নিরজাফ)-এর। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দাবি, সাধারণত প্রতি কেজি পাট পচাতে ২০ থেকে ২৫ লিটার জল লাগে। নতুন পদ্ধতিতে লাগবে কেজিতে ২ লিটার। পাট পচতে সাধারণত লাগে ১৫-২০ দিন। নতুন পদ্ধতিতে লাগবে মাত্র ৫ দিন। চাষিদের ক্ষোভ, সরকারি ‘গড়িমসি’তেই তাঁরা এখনও ওই নতুন কারিগরি ব্যবহার করার সুযোগে পাচ্ছেন না। রামপ্রসাদবাবু-সহ রাজ্য কৃষি দফতর এবং জুট কর্পোরেশনের কর্তারা অবশ্য বলছেন, বাণিজ্যিক ভাবে পাটের ছাল ছাড়ানোর যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না বলেই সমস্যা হচ্ছে।
এই চাপান-উতোরের মধ্যে সোনালি তন্তুর জন্য সোনালি দিন কবে ফেরে, দেখার সেটাই।
|
বৃষ্টির ঘাটতি |
নদিয়া |
মালদহ |
জুন |
৫৫% |
জুন |
৫১% |
জুলাই |
৬% |
জুলাই |
২৪% |
অগস্ট |
১৬% |
অগস্ট |
৪৩% |
মুর্শিদাবাদ |
দক্ষিণবঙ্গে |
জুন |
৫৩% |
জুন |
৪৬% |
জুলাই |
১২% |
জুলাই |
৭% |
অগস্ট |
৪৭% |
অগস্ট |
১৮% |
সূত্র: রাজ্য আবহাওয়া দফতর |
|
|
|
|
|
|