|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
বিতর্ক এখনও আছে |
তবু ‘আমরা-ওরা’র বাইরে আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। ‘শ্রী শম্ভু মিত্র’ নাটক দেখে এসে লিখছেন তাপস সিংহ |
সাত নম্বর লোয়ার রেঞ্জে, বহুরূপীর মহলা-বাড়ির বৈঠকখানার ডান দিকের কোণে পুরনো যে কেদারাটি রাখা, তাতে দীর্ঘ কাল প্রায় কেউই বসতেন না। যেন সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রাখা! যেন শূন্য পড়ে রয়েছে রাজার আসন, এক দিন হয়তো রাজা ফিরবেন!
ধীরে ধীরে অবশ্য সে দূরত্ব ঘুচেছে, সময় অনেক দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেও অনেক দূরত্ব ঘুচিয়েও দেয়! সে ভাবেই শম্ভু মিত্রের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা সে কেদারায় এখন অনেকেই বসেন। সেটা স্বাভাবিকও বটে। যেমন, অনতি অতীতের শম্ভু মিত্রকে মঞ্চে হাজির করানোর চেষ্টা এত দিন কেউ করেননি। কিন্তু, রক্ত-মাংসের এই অগ্রণী নাট্যকর্মীর জীবন ও কাজ, তাঁকে ঘিরে বিতর্ক, বহুরূপী-র স্থপতির এক দিন সেই সংগঠনের সঙ্গেই বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া বাংলার নাট্য-ইতিহাসের সেই ক্যানভাসে নানা রং ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এখনকার নাট্যকর্মী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহস দেখিয়েছে ‘নাট্যরঙ্গ’, ‘শ্রী শম্ভু মিত্র’ প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে। কিন্তু, কেন শম্ভু মিত্র?
এ নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করা সুরজিৎ বলছেন, “স্রেফ ‘ভিন্টেজ’ করার জন্য শম্ভু মিত্র করা নয়। আত্মমর্যাদার প্রতীক তিনি। এখনকার ‘আমরা-ওরা’র বাইরে, মেরুদণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকা একটা মানুষ! তাঁর চরিত্র মঞ্চে ফুটিয়ে তোলাটা একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার আর এ নাটকের নির্দেশক স্বপন সেনগুপ্তের কাছে। এটা আসলে ‘নাট্যরঙ্গ’র সমবেত চ্যালেঞ্জ।”
শুধুই চ্যালেঞ্জ? বিতর্ক টেনে আনা নয়? নাটকে শম্ভু মিত্র বলছেন: ‘‘এক রাজশক্তি যায়, গণতন্ত্রের নামে আর এক রাজশক্তি আসে। কিন্তু পাল্টানোর নামে এক জন আর এক জনকে নকল করে। রঙের বদল ঘটে। ঢঙের বদল ঘটে। কিন্তু সংসারে আমরা যে সং, সেই সঙের বদল তো ঘটে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে সবাই একা করে দেয়।...আমার চাঁদবণিক এই রকম একা হয়ে গিয়েছিল।’’
শম্ভু মিত্রকে কেন্দ্র করে মঞ্চে এসেছে তাঁর অভিনীত নাটকের বিভিন্ন চরিত্র। তারা যেন সূত্রধরের কাজ করে। দর্শককে টেনে নিয়ে যায় এক অধ্যায় থেকে আর এক অধ্যায়ে।
ঠিক যেমন উৎপল দত্তের প্রসঙ্গ! ‘সর্দার’ সোচ্চার হয় তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে। ‘উৎপল দত্তের জেলমুক্তির দাবিপত্রে সই দেননি কেন?...’ শম্ভু মিত্র: ‘যে ‘কল্লোল’ নাটক নিয়ে মূলত উৎপল দত্তকে সরকার গ্রেফতার করেছিল, সে নাটকটার ইতিহাস আমার কাছে সত্যের অপলাপ বলে মনে হয়েছিল, একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেটা যতই মহৎ বলে মনে হোক, তিনি জেনে-বুঝে ভুল ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন। এইটে খুব সফল হয়েছিল। পার্টি তার হিসেবমতো খুব মদত দিয়েছিল।...ওঁরই ‘মানুষের অধিকারে’ নাটককে কেন্দ্র করে যদি শাসক গোষ্ঠী প্রশ্ন তুলত, তা হলে আমি ওঁকেই সমর্থন করতুম। কারণ, সে নাটকটা আমি বিশ্বাস করেছি। এটা করিনি। তাই সই দিইনি।’ |
|
শম্ভুবাবুর সঙ্গে নেপথ্যে থাকা উৎপল দত্তের (কণ্ঠে সুপ্রিয় দত্ত) কথোপকথন আমাদের চমৎকৃত করে। উৎপল: ‘কল্লোল’-এর শেষ দৃশ্যে যখন শতছিন্ন লাল পতাকাটা আস্তে আস্তে উঠত, তখন দর্শকরা কি উদ্বেল হত, জানেন?’ শম্ভু: ‘আজও তারা উদ্বেল, সবুজ আবির নিয়ে। তুমি তোমার সমস্ত প্রতিভা শক্তি ঢেলে দিয়েছিলে বামপন্থাকে সুপারহিট করাতে। জমিয়ে দিতে। বিশ্লেষণ করতে ইন্ধন যোগাওনি। ব্যক্তিমানুষের উদ্বোধনের কথা বলনি। তাই অচিরে এক জন তথাকথিত ট্রায়েড কমরেড অবলীলায় ধূর্ত প্রমোটার হয়ে যায়। বাধে না।’
‘বহুরূপী’তে ভাঙন ধরল কেন? বাংলা নাট্যজগৎ, নাট্যপ্রেমীরা এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আর জল্পনা-কল্পনা করেছেন। সে পর্ব লিপিবদ্ধ আছে নানা গ্রন্থে, পত্রপত্রিকায়, নথিতে, স্মৃতিতেও! বহুচর্চিত সেই প্রসঙ্গ এসেছে এই নাটকেও। বল্লভাচার্য: ‘পুতুল খেলা’ নাটকের মহলায় এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল।...হঠাৎ, অভ্যস্ত সেই সুর কেটে গিয়ে বিরোধী হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর। মহলা থেমে গেল। শম্ভুদা যা কোনও দিন করেননি, তাই করেছিলেন, তৃপ্তি মিত্রের ‘ঝুলন’ আবৃত্তির সময়ে আঙুলে চাবির রিংটা ঘোরাচ্ছিলেন।’ শম্ভু: ‘...চাবিটা কিন্তু নাটকের বাইরের জিনিস ছিল না। ওটা ছিল ইন দ্য লিস্ট।’ নন্দিনী: ‘তৃপ্তি মিত্র বলেছিলেন, আগে তো এমনটা করতে না? আজ কী হল?’ শম্ভু: ‘শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, এ নাটকের ডিরেক্টর কে, তুমি না আমি? সেটা আগে ঠিক হোক।’ বেনীনন্দন: ‘এই কথা বলে শম্ভু মিত্র বেরিয়ে গেলেন।’
ইতিহাস আরও অনেক কিছু শোনায়। কিছুটা তথ্য, কিছুটা কল্পনার রং মেশানো ইতিহাস। তাতে অবশ্য শ্রী শম্ভু মিত্রের কিছু যায়-আসে না!
অসাধারণ মঞ্চ পরিকল্পনায় কৌশিক সেন প্রধান চরিত্রটিকে যেন ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। এ নাটকের সম্পদ রুদ্রপ্রসাদের ভূমিকায় নেপথ্যে থেকে স্বয়ং রুদ্রপ্রসাদের কণ্ঠ। সশরীরে না থেকেও শুধু কণ্ঠ-অভিনয়ে এ নাট্যকে জীবন্ত করে রেখেছেন তিনি! আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের সঙ্গীত নাটকটিকে বেঁধে রেখেছে ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। আর অভিনেতা সুরজিৎ? তাঁর অসামান্য অভিনয়ে শম্ভু মিত্র চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।
নাটককার সুরজিৎ বলছেন, “শম্ভু মিত্রকে বোঝাতে গেলে প্রায়শই হয় নকল হয়েছে, নয় তাঁকে কার্যত ভ্যাঙানো। কিন্তু এই চরিত্রও যে মঞ্চস্থ করা যায়, সেই সাহস যোগানোর মূলে ব্রাত্য বসুর ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’। প্রথম নাট্যরূপ শোনাই শঙ্খ ঘোষকে। তাঁর পছন্দ হয়। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় শম্ভুবাবুর বলার ভঙ্গিতেই পড়ি। তবে, তাঁর গলা কখনও নকল করিনি। কারণ, গলা নকল করে শম্ভু মিত্র করা যায় না। কিন্তু তাঁর সেই বাচনভঙ্গি অনুপুঙ্খ তোলার চেষ্টা করেছি। তাঁর দুটো বয়সকে ব্যবহার করেছি।
প্রথমে গলার জোয়ারিটা শুরু হয়। কখনও কখনও আবার গলাটা অন্তর্লীনও হয়ে যায়।”
বাগবাজার স্ট্রিট লাগোয়া যে শান্তি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতে সুরজিৎ রোজ ফেরেন, সে বাড়ির উঠোন থেকে একটি মাধবীলতার গাছ মাথা তুলতে তুলতে আজ তাঁর দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারে। ’৯৬ সালে সেই মাধবীলতা লাগিয়েছিলেন সুরজিতের স্ত্রী অনিন্দিতা। তার পরের বছর থেকে সুরজিতের একটানা অভিনয়ের শুরু। প্রশান্ত হাসি মাখিয়ে সুরজিৎ বলেন, “ওকে বড় ভালবাসি।’
সে কথায় মনে পড়ে যায় শম্ভু মিত্রের ‘প্রেমের পরিশ্রম’ লেখাটির কথা। লিখছেন: ‘‘এক দিন এক পরাজিত সন্ধ্যায় আমি রাগ করে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ‘তুই রয়েছিস কী করে এত দিন থিয়েটারে? থিয়েটার তোকে কী দিয়েছে? বারে বারে শুধু তোকে ঠকিয়েছে। সার্থক ক’রে দেবে বলে লোভ দেখিয়ে তার পরমুহূর্তেই তোকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। তোর লজ্জা করে না? তুই আছিস কী করে?’ ক ক্লান্ত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা ভাবল। তারপর দুঃখের হাসি হেসে মাথা নেড়ে বললে, ‘কী করব, আমি-যে ভালবেসেছি।”
‘শ্রী শম্ভু মিত্র’ আবার ভালবাসতে শেখাল! |
|
|
|
|
|