পূর্ব কলকাতা: লেকটাউন, বারাসত
রাজারহাট
দুর্ভোগের বাজার
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে পালটে গিয়েছে এলাকার চেহারা। বদলেছে মানুষের চাহিদাও। কিন্তু উন্নয়ন হয়নি রাজারহাট থানা লাগোয়া কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রাজারহাট বাজারের। তা রয়ে গিয়েছে সাবেক ঢঙেই। নড়বড়ে টালির চাল আর পলিথিনের নীচে সঙ্কীর্ণ পিছল পথ দিয়ে বাজারে ঢুকতে রোজ সমস্যার মুখে পড়তে হয় ক্রেতাদের। বর্ষায় সমস্যা চরমে ওঠে। অভিযোগ, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে ওঠা বাজারটির উন্নয়ন নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেই ব্যবসায়ী সমিতি, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদের। ফলে রোজ ভুগতে হচ্ছে কয়েকশো ক্রেতাকে।
স্থানীয় লোককথা অনুসারে, রাজা গজেন্দ্রনারায়ণ রায় বর্তমান বাজারটির জায়গায় একটি হাট শুরু করেন। সেই থেকেই এই এলাকার নাম রাজারহাট। এখনকার বাজারটি সুপ্রাচীন সেই হাটেরই পরিবর্তিত রূপ। সেই হিসেবে এর বয়স কয়েক শতাব্দী। বর্তমানে রাজারহাট ব্লকের রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের পূর্ব ও পশ্চিম ভাতেন্ডা, নৈপুকুর, কাজিয়ালপাড়া, জগদীশপুর, নবাবপুর, মাঝেরআটি প্রভৃতি গ্রামের মানুষের জন্য এটিই একমাত্র বড় বাজার। এ ছাড়া, বারাসত-২ নম্বর ব্লকের দেয়াড়া, গলসিয়া, রাজবাটী, ভাতুড়িয়া প্রভৃতি গ্রামের মানুষও কেনাকাটার জন্য আসেন এখানেই।
কমবেশি বিঘাখানেক জমিতে দু’দিকে পুরনো অশক্ত ইটের থাম। তার উপরে নড়বড়ে টালির চালের মাঝে পলিথিন টাঙানো অবস্থায় চলছে বাজার। চাল, সব্জি ও মাছের এই বাজারে সবমিলিয়ে শ’খানেক দোকান। অথচ যাতায়াতের রাস্তা বলতে সরু খানতিনেক গলি। জোরে বৃষ্টি হলে সেগুলিতেও বিক্ষিপ্ত ভাবে জল জমে। ক্রেতাদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। বাজারের ভিতরে কোনও নর্দমা না থাকায় হাঁটার পথ ধরেই জল বেরিয়ে বাজারের পাশের পাকা নর্দমার মুখে জমে দুর্গন্ধ ও দূষণ ছড়ায়। এ দিকে, কাদামাখা রাস্তায় ফেলে দেওয়া পাতা ও সব্জি পচে পিছল হয়ে যায় আরও। ফলে পিছলে পড়ে চোট পাওয়ার আশঙ্কাও বাড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা হবিবর রহমান বলেন, “লাগোয়া পাকা রাস্তার গায়ে এই বাজারের ভ্যাট। জঞ্জাল উপচে মাঝেমধ্যে রাস্তায় চলে আসায় যাতায়াতে সমস্যা হয়। বাজারের মধ্যে হাঁটতে গেলেও পিছলে পড়ার ভয়। আর বর্ষায় কেনাকাটা করতে যাওয়া তো শাস্তির মতো। মাথায় পলিথিন ঠেকে, জলে ভিজতে হয়।” এর পাশাপাশিই ক্রেতাদের আশঙ্কা, বাজারে ঢোকা-বেরনোর পথ এতটাই অপরিসর যে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে যথেষ্ট সমস্যা হতে পারে।
অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের সচেতনতার অভাবেই বাজারের ভিতরে বিক্ষিপ্ত ভাবে আবর্জনা জমে। সেই স্তূপ ও শৌচাগার থেকেই দূষণ ছড়ায়। বাজারের নলকূপ খারাপ হলে সময়মতো সারানো হয় না বলেও অভিযোগ। ফলে নলকূপ থেকে জল বেরিয়ে পাকা নর্দমায় পড়তে পারে না। জল জমে কাদা হয়ে থাকে। এক সময়ে জেলা পরিষদ এই বাজারের উন্নয়নে উদ্যোগী হলেও বাজারের জমির মালিক সহযোগিতা না করায় উন্নয়ন হয়নি বলেও অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, “বাজারের জমির মালিককে দোকানপিছু ৩ টাকা দিতে হয়। কিন্তু মালিক এর উন্নয়নে উদ্যোগী নন। তিনি উদ্যোগী হলে আমরাও সহযোগিতা করব।”
বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক ইউসুফ আলির কথায়: “অনৈক্যের জেরে ব্যবসায়ী সমিতি কয়েক বছর আগে থেকেই অকেজো। এখন ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের দোকানপাট অল্পবিস্তর সারিয়ে নেন। কয়েক বছর আগে সমিতির উদ্যোগে মাছবাজারের কিছু উন্নয়ন হলেও সার্বিক উন্নয়নের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।”
প্রশাসনের তরফেও অবশ্য ছবিটা সেই দায় এড়ানো এবং চাপান-উতোরেরই। জেলা পরিষদের স্থানীয় সদস্য, সিপিএমের আল্পনা দাস বলেন, “বাজারের উন্নয়নে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগী হওয়া উচিত। তারা না পারলে জেলা পরিষদ ভাববে।” রাজারহাট পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি, তৃণমূলের গৌরপদ দাসের কথায়: “পঞ্চায়েত সমিতি বাজারের উন্নয়নে উদ্যোগী হলেও জমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় সরকারি কাজ করা যায়নি। মালিকপক্ষ থেকে জমি লিখে দিলে এখনও উন্নয়ন সম্ভব।” স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের উত্তম হালদার বলেন, “বাজারের উন্নয়নে এক সময় জেলা পরিষদের সভাপতি উদ্যোগী হলেও জমির মালিক সহযোগিতা না করায় কাজ এগোয়নি।” তিনি আরও বলেন, “স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের সচেতনতার অভাবে বাজারের পাশের নর্দমাটি বারবার আবর্জনায় আটকে যায়। সেটি যাতে নিয়মিত সাফ করা যায়, তা দেখছি।”
অভিযোগ অস্বীকার করে বাজারের জমির মালিক, রেকজোয়ানি নিবাসী কৃষ্ণচন্দ্র পাল বলেন, “সভাপতি এক বার বাজারের উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আমিও সহযোগিতার কথা বলি। তার পরেও কেন কাজ হয়নি, জানি না। জেলা পরিষদ আবার উদ্যোগী হলে সহযোগিতা করব। বাজার থেকে যা উপার্জন হয়, তাতে বড়সড় উন্নয়ন সম্ভব হয় না। বাজারের সাফাই করাতেই সব খরচ হয়ে যায়। সরকারি ভাবে উন্নয়ন হলে ভালই হয়।”

ছবি: সুদীপ ঘোষ




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.