রাজকুমারের কাপড় লইয়া হুলুস্থূল বাধিয়াছে। রাজকুমার নিজে ঈষন্মাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিলেও পাত্রমিত্র মন্ত্রী-অমাত্য সকলে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িয়াছে: রাজকুমারের কাপড় কোথায়! বিস্তর মাথা চাপড়াইয়াও যখন কাপড়ের খোঁজ মিলে নাই, তখন একটিই পথ বাকি থাকে, বিনা-কাপড়ে কুমারের চেহারা যাহাতে জনমানসে ছড়াইয়া না পড়ে, তাহার ত্বরিত ব্যবস্থা। সুতরাং ঢাকো-ঢাকো রব চতুর্দিকে। ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র দুনিয়ায় ফরমান জারি হইয়াছে, রাজকুমারের বে-আব্রু ছবি ছাপা চলিবে না! ইতিপূর্বেও একাধিক বার ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই কনিষ্ঠ সন্তানটি পরিবারকে ভাবাইয়া তুলিয়াছেন, কিন্তু এই বার লাস ভেগাস-এ আমোদিত আহ্লাদিত কুমার হ্যারি যে ভাবে হোটেলের ঘরে নিরাবরণ দেহে নিরাবরণ বান্ধবীদের সহিত প্রমোদপ্রহর যাপন করিয়াছেন এবং ক্যামেরাফোনের মাধ্যমে তাহার সমুদয় চিত্র-প্রমাণাদি ঝড়ের অপেক্ষাও প্রবল বেগে বিশ্বময় বিস্তৃত হইয়াছে তিনি নিজেও সম্ভবত জানেন, তাহা বাস্তবিক অ-তুল্য। জনগণমানসে হ্যানোভার-বংশীয় রাজসন্তানটির কী পরিচয় পৌঁছাইল, তাহাতে পারিবারিক ঐতিহ্য কী ভাবে ধূলিমলিন হইল, রাজতন্ত্রের মর্যাদার কী অপার হানি ঘটিল, ইত্যাদি দুর্ভাবনায় (গ্রেট) ব্রিটেন এবং তাহার ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি আপাতত বিপর্যস্ত। খোদ রাজপরিবার যে এই ‘ভয়ঙ্কর’ বিপদের মধ্যে খাবি খাইতেছে, তাহার বিলক্ষণ ইঙ্গিত ব্রিটিশ সরকারি প্রতিক্রিয়ায়, জাতীয় সংবাদমাধ্যমের উপর জবরদস্তি ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের প্রতি অকুণ্ঠ অনুরোধে।
তবে কুমার হ্যারি ও তাঁহার পরিবার সম্ভবত একটি কথা এখনও উপলব্ধি করেন নাই। বোঝেন নাই যে তাঁহারা আসলে কালের পুতুলমাত্র। কালপ্রবাহের তীব্র শক্তি যেমন প্রাচীনতার প্রাচীর ভাঙিয়া অচলতার শিকড় উপড়াইয়া তাহাকে আগামী সময়ের দিকে মুখ ফিরাইতে বাধ্য করে, এই সাম্প্রতিক ঘটনাটির মধ্যেও ঠিক সেই চিরনূতনের অনতিক্রম্য ডাক। ব্রিটিশ রাজপরিবার যে ভাবে ব্রিটেনের ঐতিহ্যমনস্ক জাতীয় সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে সে দেশের সমাজে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাইয়াছেন, তাহার অর্থ এই নহে যে শতাব্দীপ্রাচীন জগদ্দল সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রথা ও মানদণ্ডকেও তাঁহারা চিরস্থায়ী গরিমায় সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করিতে একই ভাবে সফল হইবেন।
সময় অসীম শক্তিমান। কেবল রাজ-পরিবার কেন, কোনও প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষমতা নাই সেই সময়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া অপরিবর্তিত সাংস্কৃতিক সামাজিক মানদণ্ড অনন্ত কাল যাবৎ চালাইয়া যাইবার। দেশের জাতীয় সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্রিটিশরা অবারিত ভাবে ব্যক্তি-অধিকারের জয়গান গাহিবেন, আর বিপরীতে রাজ-পরিবারের অন্দরে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণত প্রতিষ্ঠানের নিকট জলাঞ্জলি দিয়া ঐতিহ্যের ধ্বজা বহন করিবেন, এই দ্বিচারিতা অধিক কাল চলিতে পারে না। আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিরই কাছে মাথা নোয়াইতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হইবে বাকিংহাম প্যালেস। ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের এই দ্বন্দ্ব তো এই প্যালেসেও কম ঘটে নাই! সেই দ্বন্দ্ব অনেক সময়ই তিক্ত-তীব্র হইয়াছে। সেই সব দ্বন্দ্বের সময় প্রিন্স চার্লস ও ডায়নার যৌবনকালে, কিংবা চার্লস ও ক্যামিলার প্রণয়কালে যদি ক্যামেরাফোন থাকিত, তবে বাকিংহাম প্যালেসকে আরও অনেক আগেই এই চরম সত্যের মুখোমুখি হইতে হইত। |