সংসদের বাদল অধিবেশন তাহার পূর্ববর্তী অধিবেশনগুলির মতোই গোলমালের মধ্য দিয়াই শুরু হইয়াছে। অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহে সভার কাজ পণ্ড হইয়াছে বিরোধী দল বিজেপির হট্টগোলে। এ বারের অজুহাত ‘কয়লা কেলেঙ্কারি’ লইয়া সি এ জি-র রিপোর্ট, যাহা সরকারের বহু কোটি টাকা লোকসান হওয়ার শঙ্কা উত্থাপন করিয়াছে। বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করিয়াছে, অন্যথায় সভা চলিতে না দেওয়ার হুমকি দিয়াছে। সাংসদদের গণ-ইস্তফার হুমকিও হাওয়ায় ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে, যদিও এই প্রশ্নে দলের দুই নেতা সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলির মধ্যে মতবিরোধ রহিয়াছে। ইউ পি এ-র প্রধান শরিক কংগ্রেসও এ বার আক্রমণাত্মক, বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি না-ছাড়িতে স্বয়ং নেত্রীই দলীয় সাংসদদের পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার নির্দেশ দিয়াছেন। ফলত গোটা বাদল অধিবেশনটিই ভণ্ডুল হওয়ার বিষম সম্ভাবনা।
এ বারের এই ঝগড়াঝাঁটি হয়তো বিজেপির দিক হইতেই শুরু। বিরোধী দল বলিয়া সরকারের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের বিরোধিতার একটা দায়ও তাহার নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে থাকিয়া যায়। কিন্তু সংসদীয় পরিবেশের হানি ঘটাইবার পিছনে কংগ্রেসের দায় কম নহে, বরং বেশি। বিরোধী দলের সহিত আলোচনা না করা, বিরোধী পক্ষের সাংসদ ও রাজনীতিকদের ইচ্ছাকৃত ভাবে উপেক্ষা করা, তাঁহাদের অস্পৃশ্য-অচ্ছুত মনে করা, এমনকী তাঁহাদের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানোতেও কংগ্রেস পিছপা হয় নাই। দৃষ্টান্ত: নরেন্দ্র মোদী। গুজরাত দাঙ্গার মোকাবিলায় রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক হিসাবে মোদীর ভূমিকা লইয়া সমালোচনা অবশ্যই হইতে পারে, পর্যাপ্ত সমালোচনা হইয়াছেও। কিন্তু গুজরাতের অর্থনৈতিক উজ্জীবনে মোদীর ভূমিকা অগ্রাহ্য করিয়া ক্রমাগত তাঁহার সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি প্রচার করিয়া কংগ্রেস আসলে বিজেপিকে এক দশক আগের গুজরাতে ফিরাইয়া দিতে চায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে বিজেপির ভূমিকা লইয়া কংগ্রেসের নিরবচ্ছিন্ন প্রচারের মধ্যেও তাহাকে কোণঠাসা করার এবং সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ বলয়েই আটকাইয়া রাখার কৌশল স্পষ্ট। অথচ অন্তত বাবরি মসজিদ ধ্বংস হইতে দেওয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের নিশ্চেষ্টতার ভূমিকাও খুব প্রশংসার্হ ছিল না।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অচ্ছুত শনাক্ত করিয়া তাহার সম্পর্কে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অনাস্থা ছড়ানোর একটা ঐতিহ্য এ দেশে উত্তরোত্তর প্রকট। বফর্স কেলেঙ্কারির ধুয়া তুলিয়া রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। অপ্রমাণিত সেই কেলেঙ্কারির অভিযোগভিত্তিক কুৎসা অভিযানের নেতৃত্ব দিয়াছিলেন বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ আর তাঁহার পারিষদ ছিলেন বিজেপি ও বাম রাজনীতিকরা। সেই সমবেত বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার রাজীবের বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঘৃণার বাতাবরণ রচনা করে, তাহার মধ্যে তাঁহাকে হত্যা করার যৌক্তিকতাও যেন কার্যত তৈয়ার হইয়া যায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য আসমুদ্রহিমাচল করসেবকদের অযোধ্যায় সমাবেশিত করার পিছনেও তো ছিল রামমন্দির ধূলিসাৎ করিয়া তথায় মসজিদ নির্মাণের সাড়ে চারশো বছরের গল্পকথা, যাহা গোঁড়া হিন্দু জনমানসে পরিকল্পিত মুসলিম-বিদ্বেষ উস্কাইয়া তোলে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা কিংবা রাজনৈতিক ঘৃণা, উভয়ই ধিক্কারযোগ্য। আজ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মঙ্গোলয়েড জনজাতির বিরুদ্ধে গোঁড়া মুসলিম মৌলবাদীরা যে বিদ্বেষ ছড়াইতেছে, মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা এবং বিজেপি আবার মুসলিম জনসমাজের বিরুদ্ধে তাহার পাল্টা বিদ্বেষ ছড়াইতে ব্যস্ত। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে অসহিষ্ণুতাই যদি রাজনীতিক প্রচারের মূল উপজীব্য হয়, তবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীকে ‘প্রতিপক্ষ’ বলিয়া গণ্য করার ঐতিহ্যই থাকিয়া যায়। এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে অন্য গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অচ্ছুত গণ্য করার এই পারস্পরিক বিরূপতা পরিষদীয় রাজনীতির সমুচ্চ প্রাঙ্গণেও প্রতিফলিত হইতেছে। দুর্ভাগ্যজনক। |