ক্রিকেট স্টেডিয়াম তো নয়, যেন স্বপ্নপুরী!
যে কোনও ক্রিকেটপিপাসুর মন ভাল করে দেওয়ার মতো সব উপকরণ হাতের কাছে মজুত। ঝাঁ-চকচকে স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের কোল বেয়ে মাঠ পর্যন্ত চলে যাওয়া নানান রঙের চেয়ারের সারি। চাইলে যেন দু’ফুট দূরত্বে দেখা যাবে স্বপ্নের নায়কদের। এমনই স্টেডিয়ামের গড়নটা। প্র্যাক্টিসের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধে কী নেই! এবং সেটা আবার টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চ। যে মঞ্চে ব্যাট হাতে সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। ক্রিকেটভক্তদের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
কিন্তু মঙ্গলবারের উপ্পলের রাজীব গাঁধী স্টেডিয়ামে ঢুকতে গেলে বড়সড় ধাক্কা খেতে হচ্ছে যে! স্বপ্নপুরী বটে, কিন্তু তাতে প্রাণ কোথায়? সহবাগ আছেন। ধোনি আছেন। সচিনও আছেন। কিন্তু তাঁদের ঘিরে সেই চেনা উন্মাদনা কোথায়? বিপরীতধর্মী ছবিগুলো বরং এ রকম: দুপুর দেড়টা নাগাদ টয়োটা ইনোভায়ে উঠছেন সহবাগ-গম্ভীর। সঙ্গে চেতেশ্বর পূজারা। নিরাপত্তার চোখরাঙানি নেই। হাতে গোনা গুটিকয়েক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। হাতে ‘বুম’। কিন্তু সহবাগদের ঘিরে ভক্ত-সংখ্যা? শূন্য!
ব্যাট হাতে নেটে ঢুকছেন ‘লিটল মাস্টার’। উমেশ যাদবের পেস অগ্রাহ্য করে চকিতে বেরোচ্ছে স্ট্রেট ড্রাইভ। কিন্তু স্টেডিয়ামে উৎসাহী কচিকাঁচাদের চিল-চিৎকার? সে সব দূরস্থান, ‘প্লিজ, সচিন, প্লিজ’ বলে একটা অটোগ্রাফের খাতাও এগিয়ে এল না। মাঠে বসে মোটে একজন নিরাপত্তারক্ষী। ঢুলছেন!
শহরের ‘হৃদয়’ না থাকলে যা হয়! আর হায়দরাবাদের ‘হৃদয়’-এর নাম যে বেঙ্গিপুরাপ্পু বেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ, সেটা কে না জানে? |
আর ভারত আছে, কিন্তু লক্ষ্মণ নেই— পরিস্থিতি এ রকম দাঁড়ালে যে কী হয়, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থার কর্তারা। অবস্থা অনেকটা সৌরভকে বাদ দিয়ে ইডেনে ভারতীয় দলের নামার মতো। তফাত একটাই। সরাসরি বিক্ষোভের বদলে আছে নীরব প্রতিবাদ। কী রকম? আজ বাদে কাল টেস্ট, অথচ টিকিট বিক্রি কি না হয়েছে মোটে দু’হাজার! চল্লিশ হাজার সিটের স্টেডিয়াম যে সপ্তাহের মাঝে ভরবে না, জানা কথা। কিন্তু এই অবস্থা যে হবে, ভাবা যায়নি। মঙ্গলবার দুপুরে উপ্পলের স্টেডিয়ামে প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার শিবলাল যাদবের (বর্তমানে এইচসিএ-র ভাইস প্রেসিডেন্ট) গলাকে তাই কাতরানি মনে হয় যখন বলেন, “ভেবেছিলাম, লক্ষ্মণ ঘরের মাঠে খেলে রিটায়ার করবে। তখন ভিড়টা কী হত ভাবছি।” বিদায়ী টেস্টে লক্ষ্মণ যাতে পছন্দের উইকেট পান, সেই কর্মযজ্ঞে নেমে পড়েছিলেন কিউরেটর চন্দ্রশেখর। “ও বাউন্স ভালবাসে। সেই মতোই সব হচ্ছিল।” যাতে ইচ্ছেমতো স্ট্রোক খেলতে পারেন ‘নিজাম’। কিন্তু শনিবারের পর থেকে সব অঙ্ক ওলটপালট। উল্টে হাজার-হাজার কমপ্লিমেন্টারি টিকিট ছাড়তে হচ্ছে। লক্ষ্মণের ব্রোঞ্জ-মূর্তি বসানো হচ্ছে। নর্দার্ন স্ট্যান্ডকে ভিভিএস লক্ষ্মণের নামে করে দেওয়া হচ্ছে টেস্টের ফাঁকেই। যেখানে ধোনিদের সামনে রেখে মিনি-অনুষ্ঠান হবে, এবং এইচসিএ কর্তাদের আশা, তার লোভে কিছুটা হলেও লোক আসবে। সানিয়া-সাইনাদের টেস্টের নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে কোথায়? সাইনার বাবা হরবীর সিংহ তো পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, মেয়ের পক্ষে ব্যাডমিন্টন ফেলে টেস্ট দেখতে আসা সম্ভব না।
লক্ষ্মণ নিজে এ সব সাতে-পাঁচে থাকতে চান না। মিডিয়া থেকে শতহস্ত দূরে। আর শহরের এই আবেগ তাঁকে কতটা ছুঁয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে, এ দিন আনন্দবাজারকে লক্ষ্মণ বললেন, “আমি এ সব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। পরিবারের সঙ্গে আছি। ব্যস্ত আছি।” কিন্তু নিজের শহরে টেস্ট দেখতে আসবেন না? এ বার ছোট্ট উত্তর, “হ্যাঁ। আসব না কেন?” বোঝাই যাচ্ছে টেস্ট ‘বয়কট’ করে তাঁর মনোকষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটুক তিনি চান না।
|
বরাবরের নির্বিবাদী লক্ষ্মণ বিতর্ক চান না বোঝা গেল। কিন্তু তাতেও ধোনি-শিবিরে পুরোপুরি শান্তি কোথায়? ঘুর্ণি পিচের আশ্বাস পেয়েছেন, দু’দিন পর থেকেই নাকি বল ঘুরবে, সে না হয় ঠিক আছে। কিন্তু লক্ষ্মণ না থেকেও তো অধিনায়কের সংসারে অদৃশ্য ভাবে থেকে যাচ্ছেন। বছর পনেরো বাদে এই প্রথম টেস্টে দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ দু’টো নাম বাদ রেখে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ নামছে। সঙ্গে থাকছে লক্ষ্মণের জায়গায় বদ্রীনাথের নির্বাচনকে ঘিরে দেশজোড়া অসন্তোষের ঢেউ। এ দিন নেটে বদ্রীনাথ ব্যাট করার সময় পিছনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন ধোনি। কী দেখছিলেন, কে জানে। হায়দরাবাদ কর্তাদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ, এ কিনা লক্ষ্মণের বদলি? তাঁদের যুক্তি, তিনটে বদ্রি মিলেও একটা ঊনচল্লিশের লক্ষ্মণ হবে না।
টেস্ট বিশ্বে আট নম্বরের বিরুদ্ধেও ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর মাথা ঠান্ডা রাখা এর পর ঠিক কতটা সম্ভব? বৃহস্পতিবার থেকেই উত্তর পাওয়া যাবে। |