উৎসবের মেজাজ বদলে গেল আতঙ্কে। আনন্দের ‘রাইড’ হয়ে উঠল দুঃস্বপ্নের বাহন!
চারতলা সমান উঁচু থেকে জলের তোড়ে ভেসে ঘুরতে ঘুরতে নামার কথা ছিল। রাইড ভেঙে ১২-১৩ ফুট উচ্চতা থেকে সটান নীচে পড়ে জখম হলেন অন্তত ১৬ জন। ১২ বছরের একটি বালকও রয়েছে এই দলে। কাঁধের হাড় সরে গিয়ে সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার পরে অন্যদের রাতে ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটের এই দুর্ঘটনায় সল্টলেকের নিকো পার্কে ওয়াটার-পার্কের ‘নিরাপত্তা’ নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে। কী করে এমন বিপদ ঘটল, তা খতিয়ে দেখতে বিনোদন-পার্কটির সব ‘রাইড’ই আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। পার্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির মামলাও রুজু করা হয়েছে।
নিকো পার্কে এটাই অবশ্য প্রথম দুর্ঘটনা নয়। দু’বছর আগে রোমাঞ্চকর ট্রেন-সফর ‘মুনরেকার’-এর রেলগাড়ির চাকা বেলাইন হয়ে এক মা ও তাঁর শিশুকন্যা জখম হন। কিন্তু একসঙ্গে এত জনের জখম হওয়া এই প্রথম।
এ দিনের গোলযোগের উৎস ‘বডি-স্লাইড’ নামের ‘রাইড’টি। কেন গোলযোগ? ঢাল বেয়ে ঠিক মতো জল ছাড়া হচ্ছিল না বলে ওয়াটার-পার্কে ভিড়-করা জনতার অনেকেই অভিযোগ করেছেন। নিকো পার্ক কর্তৃপক্ষ আবার ‘বিশৃঙ্খল জনতা’র উপরেই দায় চাপিয়েছেন। কিন্তু অন্য দিনের থেকে ওয়াটার-পার্কে ভিড় বেশি হলেও একসঙ্গে অনেক জনকে টিকিট কেটে কেন ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল, তার সদুত্তর মেলেনি। ক্ষুব্ধ জনতা দুর্ঘটনার পরে পার্কের টয়লেট এবং লকার রুম ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ। |
তখন বেলা আড়াইটে। ঈদের পরের দিন উৎসবের আমেজে ওয়াটার-পার্কে ভিড় জমেছিল কাশীপুর, বেলগাছিয়া, হাওড়া বা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে আসা বহু মানুষের। থিকথিকে ভিড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ‘বডি স্লাইড’-এর সামনে জড়ো হন উৎসাহীরা। কাশীপুরের দুই স্কুলছাত্র ১৬ বছরের সুরজ আহমেদ ও ১৩ বছরের শেখ সেলিমরা বলছিল, “ফাইবারের ঢালে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো জল ছিল না। হাত দিয়ে ঘষটে নামতে গিয়ে দেখি ঘাড়ের কাছে আরও কয়েক জন।” ভিড় জমাট বাঁধার চাপেই ভেঙে পড়ে রাইডটি, একমত সকলে। সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বেলগাছিয়ার ইউসুফ হোসেন কাঁদছিলেন, “জলে পিছলে হুস করে নামার মজাটাই পাচ্ছিলাম না। উল্টে পড়ে গিয়ে কী শাস্তিই না হল!” ১৬ বছরের ইউসুফের কোমরে, বুকের পাঁজরায় চোট লেগেছে। ১২ বছরের বালক মহম্মদ ইমরানের কাঁধের হাড় সরে গিয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ইমরান এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিদের এ দিন রাতে শুশ্রূষার পরে ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
‘রাইড’-এর ত্রুটির জেরেই কি তবে ঘটল দুর্ঘটনা? বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, “বডি-স্লাইডে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কি না, খতিয়ে দেখা হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নিকো পার্কের সব ক’টি রাইড যাচাই করিয়েই আমরা ফের তা চালু করার অনুমতি দেব।” পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও হাসপাতালে দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন।
‘রাইড’-এ ত্রুটির কথা অবশ্য মানতে চাননি নিকো পার্ক কর্তৃপক্ষ। নিকো পার্কস অ্যান্ড রিসর্টস-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রাজেশ রাইসিংহানির দাবি, “প্রতিটি রাইড রোজ খুঁটিয়ে দেখে নিয়েই চালানো হয়। রাইডে যান্ত্রিক গোলযোগের অভিযোগ ঠিক নয়। ভিড় করা জনতা কথা না-শুনে একসঙ্গে ঢুকে পড়েছিল বলেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
পুলিশের অবশ্য প্রশ্ন: বাড়তি ভিড়ের ক্ষেত্রে পার্কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন আঁটোসাঁটো করা হয়নি? রাইসিংহানির দাবি, ভিড় বেশি হতে পারে এই আশঙ্কায় এ দিন দ্বিগুণেরও বেশি নিরাপত্তারক্ষী ও আধিকারিক মোতায়েন করা হয়েছিল। এ দিন ভিড় বেশি থাকলেও গ্রীষ্মের ছুটিতে আরও লোক হয়। নিকো পার্ক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এ দিন ওয়াটারপার্কে দেড় হাজার লোক ছিলেন। আড়াই হাজার লোকের ভিড় সামলানোর অভিজ্ঞতাও তাঁদের রয়েছে, কর্তৃপক্ষের বক্তব্য।
কর্তৃপক্ষের দাবি, বডি-স্লাইড রাইডটিতে একসঙ্গে দু’জনকে ঢাল বেয়ে নামার অনুমতি দেওয়া হয়। এ দিন নিয়ম না মেনে একসঙ্গে ২০-২২ জন ঢালে নেমে পড়েন। এক নিরাপত্তারক্ষীকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয় বলেও কর্মীদের দাবি।
|
কেন দুর্ঘটনা |
আহতদের বক্তব্য |
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য |
• জলের প্রবাহ ছিল না। ঘষে ঘষে নামতে হচ্ছিল।
• দ্রুত নামতে না পেরে মাঝপথে আটকে যেতে হয়।
• কর্মীরা নির্বিচারে লোক ছাড়তে থাকেন।
• রাইডের মধ্যে প্রায় ২৫ জনের ভিড়।
• বাড়তি চাপের ফলে ভেঙে পড়ে রাইড। |
• জলপ্রবাহ ঠিক ছিল। বিপত্তি এক দল যুবকের জন্য।
• ধাক্কা মেরে নিরাপত্তারক্ষীদের সরানো হয়।
• রাইডটি হাত দিয়ে আটকে রেখেছিল যুবকরা।
• পিছনের লোকেরা মাঝপথে আটকে যায়।
• বাড়তি চাপের ফলে ভেঙে পড়ে রাইড। |
|
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের বক্তব্য, একসঙ্গে এত জনকে ওয়াটার-পার্কের ভিতরে রাইড-এর কাছে উঠতে দেওয়াই ঠিক হয়নি। অত জনের চাপ ফাইবারের পলকা ‘স্লাইড’ নিতে পারেনি বলে পুলিশের ধারণা। ঘটনার পরে পার্ক কতৃর্পক্ষ আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেও গড়িমসি করেছেন বলে অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, অনেক দেরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পার্ক কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগও অস্বীকার করেছে। রাইসিংহানি বলেন, “দ্রুতই আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাই।” স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু ও বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখভাল করেন। |