এ বার মুষলধারে বৃষ্টির দেখা নেই কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায়। আর তাতেই হয়েছে বিপত্তি। শহরের আনাচে-কানাচে বৃষ্টির জল স্থির হয়ে জমে থাকছে বেশ কিছু দিন। ফলে তৈরি হচ্ছে মশার বংশবৃদ্ধির ‘আদর্শ’ পরিবেশ। আর মেঘে ঢাকা আকাশ সক্রিয় করে দিচ্ছে নানা জীবাণুকে। দু’য়ে মিলে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া-সহ অন্য জীবাণুঘটিত রোগের সংক্রমণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কলকাতা, সল্টলেকে ডেঙ্গি সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার জন্য বর্ষার ভোল বদলকেই দায়ী করছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অন্য কেউ কেউ আবার এর পিছনে ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশার জিনগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছেন। শহরের এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতা, “প্রায় ২০ বছর ধরে এই রোগের চিকিৎসা করছি। কিন্তু এ বারের মতো এমন তীব্র সংক্রমণ আগে দেখিনি। এক বাড়িতে রোগটা ঢুকলে পরিবারের সবাইকে কাবু করে ফেলছে।”
জিনগত পরিবর্তনের আশঙ্কা কেন করা হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ভাবে সেগুলি ডেঙ্গির উপসর্গ হিসেবে পরিচিত, এ বার অনেক ক্ষেত্রেই তার দেখা মিলছে না। অর্থাৎ, গাঁটে ব্যথা, গায়ে চাকা লাল দাগ নেই। কিন্তু জ্বর উঠে যাচ্ছে ১০৪ ডিগ্রিতে। তখন রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গির ভাইরাস মিলছে। আবার গাঁটে ব্যথা, গায়ে লাল দাগ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর বারবার রক্ত পরীক্ষা করেও ধরা পড়ছে না ডেঙ্গির জীবাণু। অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে তাঁদের। চিকিৎসা হচ্ছে প্যারাসিটামল, স্যালাইনে। তাতেও জ্বর না কমলে অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্য নিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এমন রোগীদের ভিড় সামলাতে বাইপাসের ধারের তিনটি এবং সল্টলেকের দু’টি হাসপাতালে এখন ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা।
রোগের উপসর্গের তারতম্যের সূত্র ধরেই এসে পড়েছে মশার জিনগত পরিবর্তনের বিষয়টি। এ দেশে মশা কিংবা ডেঙ্গি ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও, আমেরিকার জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথের এক দল গবেষক এ ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন কলকাতার ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার ওই গবেষকদের দাবি, ডেঙ্গি ভাইরাস এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশার শরীরে ঢুকলে সেই মশার জিনগত পরিবর্তন ঘটায়। ফলে তাদের লালা গ্রন্থির চরিত্রগত বদল ঘটে। এই জিনগত পরিবর্তনের জন্য ওই স্ত্রী মশার ‘রক্ত পিপাসা’ বাড়িয়ে দেয়। ভাইরাস আক্রান্ত ওই মশা রক্তের খোঁজে অনেক বেশি মানুষকে কামড়ায়। ফলে বেড়ে যায় ডেঙ্গি সংক্রমণের হার। পলস্ প্যাথোজেন জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে জর্জ ডিমপোলাস এবং তাঁর সহযোগীরা এই দাবি করে জানিয়েছেন, শারীরবৃত্তীয় কোনও বদল না হলেও স্ত্রী এডিস ইজিপ্টাই মশা পাগলের মতো রক্তের উৎস খুঁজে বেড়ায়। |
কাহিল শহর |
|
নতুন উপসর্গ |
• তলপেটের ডান দিকে চাপ ব্যথা
• জলের মতো পায়খানা
• লসিকা গ্রন্থিগুলিতে তীব্র যন্ত্রণা |
সাধারণ উপসর্গ |
• জ্বর প্রথমে কম, হঠাৎ বেড়ে যায়
• মাথা যন্ত্রণা, চোখের পিছনে ও গাঁটে ব্যথা
• গায়ে লাল লাল দাগ, চোখ লাল
• বহু ক্ষেত্রে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, বমি
• শরীর থেকে রক্তপাত শুরু
• দেহে জল কমে যাওয়ায় দুর্বলতা |
|
প্রতিষেধক কী |
• কোনও প্রতিষেধক নেই, মশা নিয়ন্ত্রণই প্রতিরোধ |
কী ভাবে প্রতিরোধ |
• বাড়ির কাছে জল জমতে দেবেন না
• ফুলদানি, কুলার, চৌবাচ্চার জল |
নিয়মিত পাল্টান |
• কৌটো, বোতল, ডাবের খোলায় যেন |
|
জল না জমে |
• মশারির মধ্যে ঘুমোন
• মশা তাড়ানোর ওষুধ ব্যবহার করুন |
রোগ কী ভাবে ছড়ায় |
• ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা কামড়ালে। |
কী ভাবে রোগ ধরা যাবে |
• উপসর্গ মিললেই রক্ত পরীক্ষা। এক বারে ধরা না
পড়লে দ্বিতীয় বার পরীক্ষা। |
|
কী ভাবে চিকিৎসা |
• চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্যারাসিটামল খান।
সঙ্গে প্রচুর জল। |
মৃত্যুভয় কতটা |
•
ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে হেমারেজিক ডেঙ্গি
(যেখানে শরীর থেকে রক্তপাত হয়) মৃত্যু ঘটাতে পারে। |
|
|
গবেষকরা আরও জানাচ্ছেন, জিনগত এই পরিবর্তনের ফলে ওই মশাদের সক্রিয়তাও অনেক বেড়ে যায়। বহু দূর থেকে তারা মানুষ কিংবা অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্তের গন্ধ শনাক্ত করে। নতুন নতুন শিকার খুঁজতে তাদের সমস্যা হয় না। মশার লালা গ্রন্থি এবং শুঁড়েই মূলত বাসা বাধে ডেঙ্গি ভাইরাস। তাই যখনই মানুষকে মশা কামড়ায়, তখনই ডেঙ্গি ভাইরাস রক্তে মিশে যায়।
মশা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয়কুমার হাটি। ডেঙ্গি ভাইরাস এডিস ইজিপ্টাই মশার কোনও চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটায় কি না, তা তাঁর নিশ্চিত ভাবে জানা নেই বলে অমিয়বাবু মন্তব্য করেছেন। কলকাতা পুরসভার এন্টেমোলজিস্ট (কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞ) দেবাশিস বিশ্বাসেরও বিষয়টি নিয়ে কোনও ধারণা নেই।
জিনগত পরিবর্তনের ওই চাপানউতোরে না গিয়ে কলকাতার পরজীবী বিশেষজ্ঞরা কিন্তু একটি বিষয়ে মোটামুটি একমত। তাঁরা বলছেন, বর্ষায় যখন মুষলধারে বৃষ্টি হয়, তখন কলকাতার মতো শহরেও জল জমে থাকতে পারে না। পুরনো জলকে ‘ভাসিয়ে দেয়’ নতুন বৃষ্টির জল। আর কিছু দিন ধরে এক জায়গায় জল স্থির হয়ে জমে থাকে না বলে মশারাও ডিম পাড়তে পারে না। কিন্তু এ বার মহানগরীতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়নি। অল্প বৃষ্টিতে আনাচে-কানাচে জল জমেছে এবং জমে থাকছে। ফলে মশা সহজে ডিম পাড়ছে।
পরিষ্কার জমা জলে ডেঙ্গির বাহক এডিস ইজিপ্টাই তো বটেই, ম্যালেরিয়ার পরজীবীর বাহক অ্যানোফিলিস মশাও ডিম পাড়ে। কিন্তু জুলাই ও অগস্টে মূলত ডেঙ্গিই সংক্রমিত হচ্ছে। ম্যালেরিয়ার আপাতত দেখা নেই। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী যেমন বলছেন, “এত ডেঙ্গি রোগী পাচ্ছি, কিন্তু ম্যালেরিয়ার পাচ্ছি না একটাও। এটাও কিন্তু ঠিক স্বাভাবিক ঠেকছে না আমার কাছে। যে পরিবেশ রয়েছে, তাতে এডিস ও অ্যানোফিলিস মশা দুটোই বংশবিস্তার করা উচিত। অ্যানোফিলিস মশা কিংবা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর জিনগত কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।” |