তখনও ছিল উষ্ণ-ঈদ মিলনী, ছিল না এমন জাঁক
পাড়ার মোড়ে সুসজ্জিত তোরণ। ‘ঈদ সম্মিলনী’। মঞ্চে ও সামিয়ানার আচ্ছাদনে ঘেরা শ্রোতাদের বসার জায়গা। প্রবেশ পথের সামনে রঙ-বেরঙের কাগজে তৈরি মালায় ও বৈদ্যুতিন আলোকমালায় মায়াবি পরিবেশ। সেখান থেকে গগনভেদি আওয়াজে গান।
গানের তালিকায় ধর্মীয় গজল থেকে ‘এক থা টাইগার’কিছুই বাদ নেই। সেই মঞ্চেই ফের স্থানীয় শিল্পীদের নাচগানের হুল্লোড়। তাকে বিচিত্রানুষ্ঠানের উত্তর-আধুনিক সংস্করণও বলা যায়। “অথচ এমনটা তো ছিল না আমাদের ছেলেবেলায়?” বললেন অশীতিপর বৃদ্ধ আলি হোসেন মণ্ডল। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ৮২ বছরের বৃদ্ধ আলি হোসেন মণ্ডল খড়গ্রাম থানার ইন্দ্রাণী গ্রামের বাড়িতে বসে পরাধীন ভারতের ঈদ মিলনীর স্মৃতি হাতড়ে দিনগুলি পুনরুদ্ধার করলেন।
১৯৩০-৩২ সাল। তখন তাঁর বয়স ১১-১২। তখন তিনি থাকেন বহরমপুর শহরের খাগড়া এলাকায়। শহরে তখন দু’টি বড় মসজিদ, একটি শহরের উত্তর প্রান্তে খাগড়ায়। অন্যটি দক্ষিনপ্রান্তে গোরাবাজার এলাকায় রাজামিঞার মসজিদ নামে খ্যাত। আলি হোসেন বলেন, “তখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ইফতার পার্টির নামে রাজনীতি গ্রাস করেনি, ‘ঈদ সম্মিলনী’র নামে নব্য যুবকদের আয়োজিত ২-৩ দিনের গানবাজনার বিচিত্রানুষ্ঠানের কথাও কার কল্পনাতে আসেনি। তাই বলে কি ঈদের দিনে মানুষে মানুষে মিলন হত না?” আলবৎ হত। এবং তা ছিল সনাতনী সমাজব্যবস্থার সংস্কৃতি থেকে জাত অন্তরের মিল, হৃদয়ের মিলন।
আলি হোসেন বলেন, “তখন ঈদের নামাজের জামাত হত মসজিদে। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই গোরাবাজারের রাজামিঞার মসজিদে ও খাগড়ার বড় মসজিদের সামনে হাজির হয়ে যেতেন এ আই সি সি-র সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্ঞান সেন, ত্রিদিব চৌধুরীর রাজনৈতিক সহযোগী সত্যেন সেন, হাইকোর্টের বিচারপতি কুমারজ্যোতি সেনগুপ্ত, সাংসদ শশাঙ্কশেখর সান্যাল, সি পি আই নেতা বিজয়কুমার গুপ্তের মতো খ্যাতনামা ব্যাক্তিরা। নামাজের পর মসজিদ ফেরত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সঙ্গে গলায় গলা, বুকে বুক মিলিয়ে তাঁরা হৃদয়ের উষ্ণতা উজাড় করে দিতেন।” কেবল শহর নয়, আবেগের ওই সস্কৃতিতে জারিত ছিল গ্রামাবাংলাও।
খড়গ্রামের ইন্দ্রাণী ও আলিনগরের মধ্যবর্তী গ্রাম চোঁয়াডাঙায় তখন লাগোয়া ৫-৭টি গ্রামের ঈদের নামাজ পড়া হত। তিনি বলে চলেন, “ঈদের নামাজ শেষ হতেই দেখতাম আগে থেকে হাজির হয়েছেন এলাকার জমিদার গোবিন্দনারায়ণ রায়, শিক্ষক শ্রীকৃষ্ণ দাস-সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট মানুষজন। তারপর পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে কি আলিঙ্গন!” সমাজ থেকে উৎসারিত ওই ঈদ মিলনীর বিবর্তন ঘটেছে রাষ্ট্রনেতাদের সচেতন ও সংগঠিত নির্দেশে ও সময়ের প্রয়োজনে।
১৯৬১-৬২ সাল। চিন-ভারত যুদ্ধ। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া স্বদেশের তখন টালমাটাল দশা। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারি উদ্যোগে প্রকাশ্য ভোটের মাধ্যমে গড়া হল ‘র্যাশানাল ভেলেন্টিয়ার ফোর্স’। ত্রিস্তর ওই ফোর্সে ছিল নির্বাচিত ‘গ্রাম-দলপতি’, ৮-১০টি গ্রাম নিয়ে ‘ইউনিয়ান দলপতি’, ৮-১০টি ইউনিয়ান নিয়ে ‘থানা দলপতি’। এলাকার রাস্তাঘাট, সাঁকো, মহামারি ব্যাধি ও নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারকে গোপন তথ্য সরবরাহ করা ছিল দলপতিদের কাজ। আলি হোসেন ছিলেন খড়গ্রাম থানা দলপতি। তিনি বলেন, “১৯৬২ সাল। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বহরমপুর ওয়াই এম এ মাঠের জনসভা। ওই সভা থেকে তিনি ঈদ ও পুজোর মতো ধর্মীয় উৎসবে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত হওয়ার জন্য ডাক দিলেন। ঐক্যবদ্ধ জাতি ও সমাজা গড়ার জন্য ঈদ সম্মিলনীর কথা বললেন।”
সেই ডাকে দ্রুত সাড়াও মিলল। ওই সময় মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের সভাপতি দুর্গাপদ সিংহ, সহ-সভাপতি বেলডাঙার মহম্মদ ইস্রাইল ও বহরমপুরের সৈয়দ আবুল হোসেন। আলি হোসেন বলেন, “নেরুদির সভার পর ইস্রাইল, আবুল হোসেন, দুর্গাপদ সিংহের উদ্যোগে গ্রান্টহলে ঈদ সম্মিলনীর আয়োজন করা হয়। সেখানে হাজির হন আর এস পি-র ত্রিদিব চোধুরী, সি পি আই এর সনৎ রাহা ও বিজয় গুপ্তের মতো নানান মত ও পথের বিশিষ্ট জনেরা।” তারও আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের সলতে পাকানোর কাজটি সেরে রেখেছিলেন লালবাগের নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা।
গবেষক খাজিম আহমেদ বলেন, “দেশভাগের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে ১৯৩৭ সালে ‘হিন্দু মুসলিম ইউনিটি অ্যসোসিয়েশন’-এর নামে নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা জনসভার ডাক দেন। লালবাগের হাজারদুয়ারির মাঠে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ১০ হাজার মানুষ সমবেত হন। আর সি আই নেতা তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর শৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, খ্যাতনামা আইনজীবী তুলসি গোস্বামী ও হুমায়ন কবীর (পরবর্তীতে জহরলাল নেহেরু মন্ত্রিসভার সদস্য)।”ওই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ছিলেন বলেই লালবাগের কেল্লা নিজামতের দক্ষিণ দরওয়াজার সামনের জায়গাটি পুজোর ও ঈদ সম্মিলনীর জন্য ১৯৫৭ সালে দানপত্র করে দেন নবাব ওয়াসেফ আলির ছেলে ওয়ারেশ আলি। ঈদ সম্মিলনীকে অভিজাতদের চৌহদ্দি থেকে মুক্ত করে আমজনতার দরবারে পৌঁছে দিতে জন্য ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সময়ের দাবিও। ১৯৬৪ সাল। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় বির্দীণ কলকাতা। তার আঁচতাপ গ্রামেও পৌঁছেছে। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গবেষক খাজিম তখন কলকাতায় শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, ‘‘সভ্যতার ওই সংকট থেকে মুক্তি পেতে মৈত্রেয়ীদেবী, গৌরী আয়ুব, অন্নদাশঙ্কর রায়-সহ মুক্তবুদ্ধিচর্চার পুজারিরা গড়ে তুললেন ‘নবজাতক’ ও ‘সংকল্প’ নামের পত্রিকাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদী গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া ছাত্রেরা। মৈত্রেয়ীদেবী, গৌরী আয়ুব, অন্নদাশঙ্কর রায়ের নির্দেশে ওই নব্যযুবকের দল নিজের নিজের জেলায় ঈদ সম্মিলনীর অনুষ্ঠান আমজনতার দরবারে পৌঁছে দেন।”
ওই রকম অতীতের কারণেই বহরমপুর বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলতে পারেন, “আজ সোমবার ঈদের দিনই ৪টি ঈদ মিলনী অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। আরও দু’ দিন ধরে যেতে হবে আরও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.