সরকারি কর্মীদের নিয়মানুবর্তিতা এবং কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করিবার কাজটি সহজ নহে। ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এই সংকট আরও তীব্র। কর্মীদের অনুপস্থিতি এবং অকর্মণ্যতার জন্য সরকারের বহু সম্পদ নষ্ট হয়, উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। কিন্তু কোনও কাজ কঠিন বলিয়াই পিছাইয়া আসা চলে না। কর্মীদের উপস্থিতি এবং কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করিবার জন্য প্রধান প্রয়োজন দুটি। এক, সদা সতর্ক নজরদারি। এবং দুই, দোষীকে শাস্তিপ্রদানের সাহস। বিহারে এই দুটিই দেখা গিয়াছে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। সেখানে সরকার চিকিৎসকদের নিয়মিত উপস্থিতির নির্দেশিকা দিয়াই ক্ষান্ত থাকে নাই, তৎসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে হঠাৎ পরিদর্শন করিয়া দোষী চিকিৎসকদের চিহ্নিত করিবার কাজটিও করিয়াছে। এক বৎসরের মধ্যে ৬২জন চিকিৎসককে শাস্তি দিবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইয়াছে। অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গে সময় মতো উপস্থিতির বিষয়ে নির্দেশ জারি করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহার পর কোনও নজরদারি করা হয় নাই, কাহাকেও শাস্তি দিবার কোনও উদ্যোগও লওয়া হয় নাই। ফলে রাজ্য সরকারের নির্দেশিকাটি আরও একটি আবর্জনায় পরিণত হইয়াছে। সরকার স্বয়ং নিজের নির্দেশের মর্যাদা না রাখিলে, তাহাকে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ না করিলে, কেনই বা চিকিৎসকরা তাহা মানিতে উৎসাহিত হইবেন? ইহার অর্থ এই নয় যে, চিকিৎসকমাত্রই কাজে নিরুৎসাহী, আলস্যপরায়ণ কিংবা উদাসীন। বরং ইহার অর্থ এই যে, যাঁহারা কর্মতৎপর এবং যাঁহারা অলস, তাঁহাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য না করিবার ফলে সরকার উত্তম চিকিৎসকদেরও অমর্যাদা করিতেছে, রোগীদের প্রতিও অন্যায় করিতেছে। এখন রাজ্য সরকার ‘বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স’ চালু করিবার উদ্যোগ করিয়াছে। ইহা নিশ্চয়ই ফলপ্রসূ হইতে পারে, কারণ এই প্রযুক্তি পূর্বে অধিগৃহীত পদ্ধতির চাইতে অনেক কার্যকর। বহু বেসরকারি সংস্থাও এই পদ্ধতি গ্রহণ করিয়া ফল পাইয়াছে। কিন্তু ইহাও যথেষ্ট নহে। ‘পুরস্কার ও শাস্তি’ যে কোনও প্রশাসন ব্যবস্থার মূল কথা। দোষীদের চিহ্নিত করিবার সাহস না থাকিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হইবে না।
অনেক চিকিৎসক হয়তো এই বক্তব্যে চিকিৎসক-বিরোধিতার প্রকাশ দেখিবেন, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যম তথা সরকারের পক্ষপাত দেখিবেন। অনেকেই অভিযোগ করিবেন, চিকিৎসা পরিকাঠামোর মৌলিক সমস্যাগুলির উপর আলোকপাত না করিয়া, চিকিৎসকদেরই বার বার কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া জনসমক্ষে সহজে বাজিমাত করিবার চেষ্টা করিতেছে সরকার, এবং তৎসহ সংবাদমাধ্যম। চিকিৎসা ব্যবস্থার ত্রুটি অনস্বীকার্য। কিন্তু হাসপাতালগুলির কার্যপদ্ধতি দেখিলে ইহাও স্পষ্ট হয় যে, চিকিৎসকরা সরকারি ব্যবস্থাকে তাঁহাদের নিজেদের সুবিধার জন্য কাজে লাগাইয়াছেন অধিক, রোগীর কথা চিন্তা করিয়াছেন অতি সামান্য। শহরাঞ্চলের হাসপাতালগুলিতে চাক বাঁধিয়া বসিয়া রহিয়াছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ হাসপাতালে কাজ পড়িলে চিকিৎসকরা সপ্তাহে কয়েক দিন মাত্র কাজ করিয়া থাকেন। প্রায় কোনও মাঝারি স্তরের হাসপাতালেই রাত্রে অস্ত্রোপচার কিংবা প্রসব হয় না। উচ্চতর হাসপাতালে কত রোগী পাঠানো হইতেছে, কী কারণে পাঠানো হইতেছে, পাঠানো সঙ্গত ছিল কি না, তাহার কোনও হিসাব কিংবা মূল্যায়ন কখনও করা হয় নাই। চিকিৎসক সংগঠনগুলি চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য আন্দোলন না করিয়া, ডাক্তারদের বদলি করা অথবা বদলি রদ করা লইয়াই ব্যস্ত রহিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনিবেন, এমনই আশা জাগাইয়াছিলেন। কাহারও রোষের পরোয়া তিনি করেন না, এমনই বার্তা পৌঁছাইয়াছিল। কিন্তু গত এক বৎসরে সেই আশা কোনও পরিণতির দিকে যায় নাই। রাজ্যবাসী এখনও পরিবর্তনের অপেক্ষায়। |