এক দিকে তিব্বত সীমান্ত জুড়ে চিনের সামরিক তৎপরতা, অন্য দিকে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। শিয়রে এমন দুই সমস্যা নিয়ে এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম সংবেদনশীল এলাকা হয়ে উঠেছে শিলিগুড়ি করিডর। তাই এ অঞ্চলে বসবাসকারীদের জন্য নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে আর সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স যথেষ্ট নয়। তাঁদের জন্য বিশেষ ‘রেসিডেন্ট কার্ড’ বা নাগরিক পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করছে কেন্দ্র।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অধীনস্থ দেশের সর্বোচ্চ কৌশলগত নীতি নির্ধারক সংস্থা স্ট্র্যাটেজিক পলিসি গ্রুপ (এসপিজি) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নয়াদিল্লির কাছে বিষয়টি এতই উদ্বেগের যে, বিষয়টি তদারকির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে একটি আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠীও তৈরি করা হয়েছে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, এর মূল কারণ তিব্বত সীমান্তে চিনা সেনাবাহিনীর তৎপরতা। শিলিগুড়ি করিডরের ১২৮ কিলোমিটার উত্তরে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা। এর এক দিকে সিকিম, অন্য দিকে ভুটান। এই চুম্বি উপত্যকার উত্তরাংশ জুড়ে পুরোদস্তুর প্রস্তুতি নিয়ে ফৌজ মোতায়েন করেছে চিন। পাশাপাশি, গোটা সীমান্ত এলাকা জুড়ে পরিকাঠামো বাড়িয়েও যাচ্ছে তারা। |
ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির মতে, যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে চুম্বি উপত্যকা ধরে শিলিগুড়ি করিডরের দখল নেওয়ার চেষ্টা চালাবে বেজিং। পূর্বাঞ্চলের সব চেয়ে সঙ্কীর্ণ ভূখণ্ডটি শিলিগুড়ি করিডরের মধ্যেই অবস্থিত। দেখতে মুরগির সরু গলার মতো, তাই নাম ‘চিকেন’স নেক’। এই এলাকার দক্ষিণে বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্বে ভুটান ও তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা এবং উত্তর-পশ্চিমে নেপাল। এখানে সব চেয়ে কম চওড়া এলাকার দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। সব চেয়ে বেশি চওড়া এলাকার দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। এই ভূখণ্ডটুকুর দখল নিতে পারলেই এ রাজ্যের একটি অংশ-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি পাহাড়ি রাজ্যের প্রায় ৫ কোটি মানুষকে দেশের বাকি অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হবে।
মহাকরণ সূত্রের খবর, শিলিগুড়ি করিডরের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কেন্দ্রের মতো রাজ্যও ওয়াকিবহাল। রাজ্য গোয়েন্দা দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, সম্প্রতি শিলিগুড়িতে তড়িঘড়ি পুলিশ কমিশনারেট চালুর প্রেক্ষাপটে রয়েছে শহর ও লাগোয়া এলাকায় সার্বিক নজরদারি বাড়ানোর লক্ষ্য। রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, অতীতে শিলিগুড়ি থেকে নেপালের প্রথম সারির মাওবাদী নেতা মোহন বৈদ্য, বড়ো জঙ্গি দলের একাধিক শীর্ষ নেতা স্যাটেলাইট ফোন-সহ ধরা পড়েছেন। শিলিগুড়ির প্রধাননগর এলাকায় একাধিক হোটেলে ঘাঁটি গেড়ে দীর্ঘদিন ধরে আলফা, নাগা, মণিপুরি জঙ্গিদের তৎপরতার বিষয়েও গোয়েন্দাদের কাছে স্পষ্ট তথ্য রয়েছে। ভুটান থেকে বিতাড়িত নেপালি উদ্বাস্তুদের (ভূপালি হিসেবে যাঁরা পরিচিত) একাংশও শিলিগুড়ির প্রধাননগর থানা এলাকায় প্রচুর বিস্ফোরক মজুত করার অভিযোগে ধরা পড়ে। উপরন্তু, বছর তিনেক আগে এক চিনা মহিলাকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। মহাকরণের এক কর্তা জানান, শিলিগুড়ি করিডরে নজরদারি বাড়িয়ে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর। কেন্দ্রকেও সব রকম সহযোগিতা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রেই জানা গিয়েছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করেই ২০১০ সালের ৩ জুন এসপিজি-র বৈঠকে শিলিগুড়ি করিডরে বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। ক্যাবিনেট সচিবের নেতৃত্বে ওই বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান ছাড়াও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)-এর প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কিন্তু, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত করা রাতারাতি সম্ভব নয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছেন। তাই ২০১২-র ২৩ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব (উত্তর-পূর্র্বাঞ্চল) শম্ভু সিংহের নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী তৈরি হয়। গত ৩০ মে ওই গোষ্ঠীর প্রথম বৈঠকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিচয়পত্র বিলির ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
কেন পরিচয়পত্র বিলি?
শম্ভু সিংহ বলেন, “এটি নিরাপত্তাজনিত কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এর বেশি আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।” পরিচয়পত্র বিলির ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তরফেও জোরালো দাবি তোলা হয়েছিল। নয়াদিল্লির সেনা সদর দফতরের মুখপাত্র কর্নেল জগদীপ দাহিয়া বলেন, “শিলিগুড়ি করিডরের অবস্থান কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওখানকার নাগরিকদের বিস্তারিত তথ্যপঞ্জি দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠীর প্রথম বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে, সেনা-সহ দেশের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি শিলিগুড়ি করিডরের প্রতিটি নাগরিক সম্বন্ধে অবহিত থাকতে চায়। সেখানে ছ’মাসের বেশি বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের উপরও নজর রাখা হবে। মোদ্দা কথা, শিলিগুড়ি করিডরে পাতা পড়লেও যাতে জানা যায়, সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে দিল্লি। তারই প্রথম ধাপ পরিচয়পত্র বিলি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সারা দেশেই ধাপে ধাপে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি তৈরি হবে। কিন্তু শিলিগুড়ি করিডরের ব্যাপারে চূড়ান্ত মত দেবে ওই আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী। প্রয়োজনে নতুন আইন আনতেও পিছপা হবে না নর্থ ব্লক।
কোন এলাকায় পরিচয়পত্র বিলি করা হবে?
রাজ্যের জনগণনা অধিকর্তা দীপক ঘোষ বলেন, “প্রথম পর্যায়ে শিলিগুড়ি করিডরের নেপাল সীমান্তের নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, বাংলাদেশ সীমান্তের ফাঁসিদেওয়া, রাজগঞ্জ, মাটিগাড়া ও শিলিগুড়ি শহর এলাকায় পরিচয়পত্র বিলি করা হবে। পরের ধাপে ইসলামপুর, হিলি, চ্যাংড়াবান্ধা, মেখলিগঞ্জ-সহ বৃহত্তর করিডরে পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু হবে।” দীপকবাবু জানান, করিডরের অবস্থানগত গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া সি চন্দ্রমৌলি গত ২৮ মে শিলিগুড়ি এসে বৈঠক করে গিয়েছেন। সংবেদনশীল এই এলাকার জন্য জেলাশাসকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। চন্দ্রমৌলি ঘুরে যাওয়ার দু’দিন পরেই নর্থ ব্লকে আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠীর প্রথম বৈঠকটি হয়েছে। |