ডেঙ্গির প্রকোপ শুরু হইবামাত্র জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি লইয়া আবার চর্চা শুরু হইয়াছে। মশা কমাইতে জল জমা প্রতিরোধ করিবার কাজ হয় নাই কেন, কেন কীটনাশক ছড়ানো হয় নাই, পতঙ্গ-বিশেষজ্ঞরা রোগ নির্ণয়ে কী করিতেছিলেন, আদৌ ওই পদে কোনও বিজ্ঞানী রহিয়াছে কি না, এমন নানা বিষয় লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। এই প্রশ্নগুলি জরুরি, সন্দেহ নাই। ব্যক্তির স্বাস্থ্য ভাল থাকিবার মূলে যেমন রহিয়াছে কতকগুলি সু-অভ্যাস, তেমনই যে কোনও নগরাঞ্চলে বা গ্রামে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রধান প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতার নিয়ম পালন। তাহার মধ্যে প্রধান নিকাশি ব্যবস্থা পরিষ্কার রাখিবার কাজটি। সাফাই ও নিকাশি যথাযথ না হইলে সার্বিক ভাবে নগরের পরিচ্ছন্নতা ব্যাহত হয়, সেই সঙ্গে সকল প্রকার রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। রোগ প্রতিরোধ কেবলই সরকারি কর্মীর কর্তব্য নহে। নাগরিকের ভূমিকা এখানে অতি গুরুত্বপূর্ণ। শহরের সকল শ্রেণির মানুষ অবাধে প্লাস্টিক ব্যবহার করিবেন, যত্রতত্র তাহা ফেলিবেন, নিজগৃহের বাহিরে রাস্তাটিকে আবর্জনার মুক্তাঞ্চল করিয়া তুলিবেন, অথচ রোগমুক্ত জীবন কাটাইবেন, ইহা সম্ভব নহে। পরিচ্ছন্নতা এবং যথাযথ নিকাশি ব্যবস্থার জন্য পুরকর্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করিবার সঙ্গে সঙ্গে, নাগরিক সংগঠনগুলিকেও এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিতে হইবে। প্রতিটি সব্জি, ফল, মিষ্টান্নকে পৃথক একটি প্লাস্টিকের থলিতে ভরিবার যে প্রয়োজন নাই, প্লাস্টিক বর্জন করিয়াও যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালানো যাইতে পারে, তাহা বুঝিতে এবং বুঝাইতে হইবে। পরিচ্ছন্নতার সাধারণ নিয়মগুলি বাজার হইতে গৃহস্থালি সর্বত্রই মানিতে হইবে, এবং এই সকল বিধিপালনকে অভ্যাসে পরিণত করিতে হইবে। কলিকাতারই নানা অঞ্চলে প্লাস্টিক-বর্জিত স্থান নির্মাণ করা সম্ভব হইয়াছে নাগরিক উদ্যোগে। বহু অপরিচ্ছন্ন স্থান আবার মনোহর হইয়াছে, বৃক্ষশোভিত, সুগম্য, আলোকিত ও নিরাপদ হইয়াছে। এই নাগরিক স্বেচ্ছা-উদ্যোগ কিন্তু গণতন্ত্রেরও একটি প্রধান লক্ষণ। শাস্তির খাঁড়া উদ্যত করিয়া অপরকে কাজ করাইব, এবং খাঁড়া উদ্যত না হইলে নিজেও কাজ করিব না, ইহা গণতন্ত্র-বিরোধী মানসিকতা।
জনস্বাস্থ্য পরিষেবা লইয়া ভারতের সমস্যা অনেকটাই ভ্রান্ত চিন্তার সমস্যা। পশ্চিমের দেশগুলিতে এবং পূর্ব এশিয়াতে ইহাকে বরাবর উন্নয়নের পরিকাঠামোর অংশ বলিয়াই দেখা হইয়াছে, যেহেতু রোগ কমিলে মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়িবে, ফলে আর্থিক বৃদ্ধিও সহজে হইবে। তাই চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিবার বহু পূর্বেই এই সকল দেশে প্রধান সংক্রামক রোগগুলি নিয়ন্ত্রণে আসিয়াছে, যাহা শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াইয়া এবং দারিদ্র কমাইয়া দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির পথ সুগম করিয়াছে। কিন্তু ভারতে বরাবরই দেখা গিয়াছে যে স্বাস্থ্যের জন্য আর্থিক বরাদ্দ প্রধানত খরচ হইয়াছে চিকিৎসা ব্যবস্থায়। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা অবহেলিত হইয়াছে। এমনকী যোজনা কমিশনের রিপোর্টগুলিতেও দেখা যায় যে, স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম বৎসরগুলিতে শৌচ-নিকাশি কিংবা কীট নিয়ন্ত্রণকে স্বাস্থ্যের মধ্যে ধরা হইলেও, পরবর্তী কালে পৃথক করা হইয়াছে এবং এগুলির গুরুত্ব কমিয়াছে। প্রশাসনিক নানা জটিলতার কারণে জনস্বাস্থ্য পরিষেবাতে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মীদের নিয়োগ করা যায় নাই। ফলে আজ ভারতে চিকিৎসায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সুলভ হইলেও, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের চাইতেও অনগ্রসর। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করিতেও নাগরিক সচেতনতা প্রয়োজন। রোগ নিরাময় হইতে রোগ প্রতিরোধে আসিতে প্রয়োজন নাগরিক উদ্যোগ। |