মিশরের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সি ক্ষমতারোহণের মুহূর্তটিকে অনেকেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন এইটুকুতেই সেই ঐতিহাসিকতার দাবি সীমায়িত ছিল না। ছয় দশকের সামরিক একনায়কতন্ত্র হইতে বাহির হইয়া প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত দলটি যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড, সেখানেও প্রচ্ছন্ন ছিল আর একটি গুরুতর ঐতিহাসিকতা। এতাবৎকাল যে মিশরের ক্ষমতাসীন সামরিকতন্ত্রের একটি বিশেষ চারিত্রলক্ষণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ২০১২ সালের মে মাসের নির্বাচন সেই ধর্মনিরপেক্ষ অ-ইসলামি শাসনের উপর যবনিকা ফেলিল, দেশের ক্ষমতার হাল ধরিল ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত দল, ব্রাদারহুড। বহু কাল যাবৎ, বস্তুত গোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কাল ধরিয়া এই ইসলামি আদর্শ ধৈর্যসহকারে মিশরে অপেক্ষমাণ ছিল, কবে দেশের শাসনক্ষমতার শীর্ষে তাহার অভিষেক হইবে। ২০১২ সালে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা সফল হইল। ঐতিহাসিক পালাবদলের মাধ্যমে মহম্মদ মুর্সি প্রেসিডেন্ট হইলেন। তবে, এত সত্ত্বেও স্বীকার করিতেই হইবে কেবল প্রতীকী অর্থেই মে মাস মিশরের পালাবদলের সূচনামুহূর্ত। প্রকৃত অর্থে পালাবদল কিন্তু শুরু হইল এই অগস্ট মাসেই। চলতি মাসটিতেই।
গত সপ্তাহে মিশরের উত্তরবর্তী সিনাই মরু-অঞ্চলে কিছু স্থানীয় আততায়ীর আকস্মিক হানায় ষোলো জন মিশরীয় পুলিশকর্মীর নিধন ঘটে যে আততায়ীদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্রাদারহুড-বিরোধী বলিয়াই জানা গিয়াছে। তাহার পর হইতেই অকস্মাৎ মিশরের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা বৃদ্ধি। প্রেসিডেন্ট মুর্সি সিনাই অঞ্চলে বিমানবাহিনী প্রেরণ করিলেন, বোমাবর্ষণের আদেশ দিলেন। এবং ত্বরিতগতিতে সামরিক বাহিনীর প্রধান পদাধিকারীদের সরাইয়া নিজের পছন্দসই ব্যক্তিদের হস্তে ক্ষমতার্পণ করিলেন। উল্লেখযোগ্য, এই সামরিক প্রধানরা সকলেই ছিলেন বিগত সামরিকতন্ত্রের উত্তরাধিকারসূত্রে কর্মরত। প্রতিরক্ষা প্রধান হুসেন তানতাওয়াই তো প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের সময়েও দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত হইতেন। ধর্মনিরপেক্ষ তকমাবাহী সামরিক কর্তাদের সরাইয়া ব্রাদারহুডের পছন্দের কর্তাদের বসানোর এই সিদ্ধান্ত দেখিতে দ্রুত হইলেও আসলে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, দূরদৃষ্টি-প্রণোদিত। অর্থাৎ ইহা শুধু নূতন প্রেসিডেন্টের নূতন ব্যবস্থাপনা নহে, ইহা মিশরের সামগ্রিক চরিত্র পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ।
এই উল্লেখযোগ্য ধাপটির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক বার্তাও রহিয়াছে। মিশরের সামরিক বাহিনীর এই অপসৃত কর্তাবৃন্দ এত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে বিশেষ অর্থসহায়তা লাভ করিতেন, এবং পরিবর্তে ইজরায়েলের সঙ্গে মিশরের সুস্থিত সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুতর ভূমিকা পালন করিতেন। হুসেন তানতাওয়াই-এর সঙ্গে পেন্টাগনের সুসম্পর্ক অতিবিশ্রুত ঘটনা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুর্সি ইঁহাদের একটানে সরাইয়া দিয়া মার্কিন ও ইজরায়েল পক্ষকে দৃঢ় বার্তা পাঠাইলেন: সময় পাল্টাইয়াছে। আর সুস্থিতির মিত্রতা নহে। এ বার অস্তিত্ববাদী কূটনীতি। প্রয়োজনে মার্কিন-ইজরায়েল পক্ষের বিরুদ্ধাচরণেও দ্বিধা করিবে না মিশর। প্রয়োজনে পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি শক্তির পাশে দাঁড়াইতেও অস্বীকৃত হইবে না মিশর। নিজের স্বার্থ অনুযায়ীই মিশর চলিবে, এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের শাসনাধীন দেশের স্বার্থ অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি আদর্শ-প্রসূত হইবে, তাহার উপর মার্কিন জবরদস্তি চলিবে না। স্বভাবতই ওয়াশিংটন শান্তিতে নাই। ‘আরব বসন্তে’র আশাময়ী বিদ্যুৎরেখা আপাতত ইসলামি গণতন্ত্রের কৃষ্ণমেঘে আবৃত। মিশর এখন গণতান্ত্রিক ইহার অর্থ আপাতত মিশর এখন ব্রাদারহুড রাষ্ট্র। মিশরের সমস্ত প্রতিষ্ঠান এখন ব্রাদারহুডায়নের করাল সংস্কারে গ্রস্ত। |