ধনঞ্জয় থেকে সাজ্জাদ, বহুতলে সুরক্ষা বেআব্রুই
ক্ষিণ কলকাতার আবাসনে লিফটম্যান তথা নিরাপত্তারক্ষীর লালসার শিকার হয়ে খুন হন অষ্টাদশী হেতাল পারেখ। সাল ১৯৯০। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে বাঁকুড়ার ছাতনা থেকে গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত নিরাপত্তারক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে। বিচারে তার ফাঁসি হয়।
দু’দশকেরও বেশি সময় পরে মুম্বইয়ের অভিজাত ওডালা এলাকার আবাসনে আইনজীবী পল্লবী পুরকায়স্থের খুনের সঙ্গে হেতাল পারেখের ঘটনার মিল পাচ্ছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রেও অপরাধী আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী, সাজ্জাদ মোগল। তবে হেতাল পারেখের ঘটনার সঙ্গে পল্লবী খুনের ফারাক একটাই। পল্লবীকে ধর্ষণ করতে পারেনি সাজ্জাদ। ধনঞ্জয়ের মতো সে-ও ঘটনার পরে পালায়। পরে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আর এই ঘটনা বহুতলের আবাসনের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার ছবিটা ফের বেআব্রু করে দিল। সুরক্ষার জন্য সিসিটিভি, নিরাপত্তরক্ষীর পোশাক-ব্যাজ সব কিছুই থাকছে, তবু তার মধ্যেও থাকছে মস্ত ফাঁক। যেখান থেকে ভক্ষক হয়ে ওঠার সুযোগ পায় ধনঞ্জয় বা সাজ্জাদরা। হেতাল পারেখ-খুনে অভিযুক্ত ধনঞ্জয়ের ঠিকানা আবাসনের পরিচালন-কর্তৃপক্ষের কাছে থাকায় খুনির সন্ধান পেতে সুবিধা হয়েছিল কলকাতা পুলিশের। কিন্তু পল্লবী-খুনে অভিযুক্ত সাজ্জাদের খোঁজ পেতে হিমশিম খেয়েছে মুম্বই পুলিশ। কারণ, সঠিক ঠিকানাই ছিল না আবাসন-কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থার কাছে। শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা গেলেও তার আগে গোটা শহর তোলপাড় করে ফেলতে হয়েছে পুলিশকে।
গোটা ঘটনায় অবধারিত ভাবেই উঠে এসেছে সেই গুরুতর প্রশ্নটা খোঁজখবর না নিয়েই যে ভাবে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো লোক নিয়োগ করে এবং বিভিন্ন ফ্ল্যাট বা আবাসনের দায়িত্ব তাদের দিয়ে দেয়, তাতে বাসিন্দাদের সুরক্ষার প্রশ্নটা কতটা গুরুত্ব পায়?
পল্লবী-খুনের তদন্তে নেমে মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের অফিসারেরা যখন অকুস্থলে পৌঁছন, ততক্ষণে সাজ্জাদ উধাও। খোঁজ করে জানা যায়, আবাসনের বাকি কাশ্মীরি নিরাপত্তারক্ষীদের মতো সাজ্জাদও একজন। এ এইচ সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্মী। কিন্তু কী তার ঠিকানা?
মুম্বইয়ের এই বহুতলেই থাকতেন পল্লবী। ছবি: পিটিআই
স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় ঝুপড়িতে সাজ্জাদকে না পেয়ে সিকিউরিটি এজেন্সিকে চেপে ধরে পুলিশ। সংস্থার কাগজপত্র ঘেঁটে সাজ্জাদের যে পরিচয়পত্র পাওয়া যায়, তাতে ঠিকানা লেখা ছিল এ রকম ‘সাজ্জাদ আহমেদ মোগল। লালচক। শ্রীনগর। জম্মু ও কাশ্মীর’। সাংবাদিক বৈঠকে প্রসঙ্গটি তুলে মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের যুগ্ম-কমিশনার হিমাংশু রায় বলেন, “উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে এই ঠিকানার অর্থ এ রকম যে, কারও বাড়ি মুম্বইয়ের আজাদ ময়দান!” কলকাতার পুলিশ কর্তারা যার অনুকরণে বলতেই পারেন, কারও বাড়ির ঠিকানা হল কলকাতার ধর্মতলা!
ক্ষুব্ধ হিমাংশুর কথায়, “বেসরকারি নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি যদি এতটাই নির্বোধ হয়, তা হলে বোধগম্য বহুতলের নিরাপত্তা কতটা ফাঁপা। শুধু তাই নয়, সাজ্জাদকে জেরা করে জানা গিয়েছে, শ্রীনগর নয়, সে আদতে উরি, বারামুলার বাসিন্দা!” অর্থাৎ যে ঠিকানা দিয়ে সে কাজে ঢুকেছিল, সেটা পুলিশের কাছে একেবারেই ‘অকাজের’!
ওডালার যে হিমালয়ান হাইটস আবাসনে পল্লবী থাকতেন, সেটিতে চারটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়েছিল এ এইচ সিকিউরিটি। কিন্তু কোনওটিই এখন কাজ করছে না। কাজেই খুনের তদন্তে নেমে সিসিটিভি-র কোনও ফুটেজ হাতে পায়নি পুলিশ। এমনকী খুনের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও আবাসনের নিরাপত্তা এতটাই শিথিল যে, সেখানকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়েই দিব্যি ঢুকে পড়া গিয়েছিল ভিতরে! লিফটে উঠে ষোলো তলায় পল্লবীর ফ্ল্যাট পর্যন্ত পৌঁছতে কেউ বাধা দেননি!
তবে ‘হাত গুটিয়ে থাকতে চাইছে না’ মুম্বই পুলিশ। বরং হিমাংশু আজ জানান, “বেসরকারি নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় আইন পর্যালোচনা করে শীঘ্রই বেসরকারি নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি সম্পর্কে তদন্তে নামবে পুলিশ। তার পর সেই রিপোর্ট অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।”
মুম্বইয়ের ঘটনার পরে কলকাতার বহুতলগুলির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বেড়েছে পুলিশের। গত বছর উল্টোডাঙার বিধান আবাসনে এক বৃদ্ধার খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছিল, বাড়িতে কাজ করতে আসা রঙের মিস্ত্রি ও তার দলবলই ঘটনার জন্য দায়ী। তদন্তে জানা গিয়েছিল, ওই বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মীর যোগসাজসেই রঙের মিস্ত্রি তার দলবল নিয়ে সহজেই বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁকে খুন করে পালিয়েছিল।
পরিচারকের হাতে গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী খুনের বেশ কয়েকটি ঘটনা সাম্প্রতিক কালে ঘটে গিয়েছে এই শহরেই। আর বেশির ভাগ ঘটনার পরেই দেখা গিয়েছে, ওই পরিচারক বা পরিচারিকার সঠিক ঠিকানাই নেই বাড়ির লোকের কাছে। তাই অপরাধীকে খুঁজে বের করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে পুলিশকে। বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকা কিংবা নিরাপত্তা রক্ষীদের নাম ঠিকানা, ছবি স্থানীয় থানায় জমা দেওয়ার জন্য কলকাতার বহুতলের আবাসিকদের কাছে বার বার আবেদন জানিয়েছে পুলিশ। কিন্তু ফল মেলেনি তাতে।
পল্লবীর ঘটনার পরে ফের এ নিয়ে এক দফা নাড়াচাড়া হলেও তাতে কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয়ে লালবাজারের কর্তারাই। ওডালার মতো ঘটনা কলকাতার বালিগঞ্জ বা লেক টাউনে ঘটলে অভিযুক্তকে ধরতে কলকাতা পুলিশকেও যে মুম্বই পুলিশের মতোই নাকানিচোবানি খেতে হবে, তাও মানছেন তাঁরা।
যে সরষে দিয়ে ভূত তাড়ানোর কথা, তার মধ্যেকার ভূতটাকে তাড়ানো যায় কী করে, সেই উপায় খুঁজছে মুম্বই পুলিশ। কলকাতা পুলিশও ।

সহ প্রতিবেদন: কলকাতা ব্যুরো


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.