পঁচিশ বছরের শরীরটায় এত রক্ত ছিল!
লিফটের বাইরে পা রাখতে যাব, সামনেই রক্তস্রোত! প্রথম ধাক্কায় সভয়ে ফের ঢুকে পড়লাম লিফটে! সাদা মার্বেলের মেঝেয় বড় বড় রক্তের ফোঁটা! দরজার কাছে চাপ চাপ রক্ত। তাতে পায়ের ছাপ, ধস্তাধস্তির চিহ্ন। দুই প্রতিবেশীর কলিং বেলের স্যুইচ, দু’দিকের দেওয়ালেও রক্তের দাগ স্পষ্ট! ঘরের মেঝেতে যেন স্রোত বয়ে গিয়েছে!
ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পরে সে রক্ত অবশ্য শুকিয়ে গিয়েছে। তবে তা কালচে হওয়ার আগেই পল্লবী পুরকায়স্থ হত্যাকাণ্ডের কিনারা করে ফেলল মুম্বই পুলিশ।
তারা বলছে, নিতান্ত ঝগড়ার বশে কোনও প্রতিহিংসা নেওয়া নয়, বরং ‘বিকৃত প্রবৃত্তির তাড়নায়’ সুপরিকল্পিত ভাবেই ঠান্ডা মাথায় পল্লবীকে খুন করেছিল অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তারক্ষী, বাইশ বছরের কাশ্মীরি যুবক সাজ্জাদ আহমেদ মোগল! যা মনে করিয়ে দিচ্ছে কলকাতায় হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। কিশোরী হেতালকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
মধ্য মুম্বইয়ের এই ওয়াডালা মূলত ছিল শিল্পতালুক। তারই পশ্চিম দিকে ফাঁকা জমিতে হালফিলে কিছু সমবায় আবাসন হয়েছে। সামনে নির্মীয়মাণ মুম্বই এলিভেটেড মেট্রোর ওয়াডালা স্টেশন। ইট, কাঠ, লোহালক্কড়ের ঢিবি। রাস্তার এ পারে আর পাঁচটা অ্যাপার্টমেন্টের মাঝে ‘হিমালয়ান হাইটস’। তার ষোলো তলার ‘১৬০১’ নম্বর ফ্ল্যাটটিতে লিভ-ইন পার্টনার অভীক সেনগুপ্তের সঙ্গে থাকতেন পঁচিশ বছরের বাঙালি আইনজীবী পল্লবী। অভীক পুণে ল কলেজ থেকেই তাঁর বন্ধু। এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন তিনি, পেশায় তিনিও আইনজীবী।
কিন্তু কী ঘটেছিল পরশু রাতে? তা হলে শুনুন মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ কী বলছে-
অভিনেতা প্রযোজক ফারহান আখতারের বিনোদন-সংস্থা এক্সেল এন্টারটেনমেন্টের আইনি উপদেষ্টা ছিলেন পল্লবী। কমবেশি রোজই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। পরশু রাতেও ফিরেছিলেন দেরি করে। ১১টা নাগাদ। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে স্যুইচ টিপে দেখেন আলো জ্বলছে না। অথচ অ্যাপার্টমেন্টের সবার ঘরে আলো জ্বলছে। অভীক তখনও অফিসে। ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জার (বিবিএম) থেকে টেক্সট করেন তাঁকে। ‘ঘরে পাওয়ার সাপ্লাই হচ্ছে না।’ |
ফ্ল্যাটের এই ঘরেই পড়ে ছিল পল্লবীর দেহ। —নিজস্ব চিত্র |
স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ানকে ফোন করার পরামর্শ দেন অভীক। বিবিএম-এ আরও কিছুক্ষণ দু’জনের কথা চলে। এর মাঝেই পল্লবীর ফোন পেয়ে চলে আসেন পরিচিত ইলেকট্রিশিয়ান। সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তা রক্ষী সাজ্জাদ মোগল। ম্যাডামের ‘নিরাপত্তার কথা ভেবে অত রাতে’ ইলেকট্রিশিয়ানকে একা ছাড়েনি সাজ্জাদ। বিদ্যুতের লাইন চেক করার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো জ্বলে ওঠে ১৬০১ নম্বর ফ্ল্যাটে। সাজ্জাদ ও ইলেকট্রিশিয়ানকে বিদায় দিয়ে সাড়ে ১২টা নাগাদ শোবার ঘরে চলে যান পল্লবী। রাত ১টা বেজে ৩ মিনিটে ফের তাঁর ব্ল্যাকবেরি থেকে টেক্সট করেন অভীককে, এবং সেটাই শেষ টেক্সট‘‘লাইট হ্যাজ গন এগেন। ইফ দ্য ইলেকট্রিশিয়ান কামস, ওকে। ইফ নট, অ্যাম গোয়িং টু স্লিপ।” কিন্তু ইলেকট্রিশিয়ান ফের আসেন। সঙ্গে ছিল সাজ্জাদও। ঘরের লাইন, বেসমেন্টের মিটার বক্স পরীক্ষা করে ঠিকঠাক করে দেন। পল্লবীকে বলেন, “ম্যাডাম, আপনি ঘরের সব হাই ভোল্টেজ অ্যাপারেটাসফ্রিজ, টিভি, এসি বন্ধ করে দিন। শুধু ঘরের পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে ফের লাইন চেক করব।” পল্লবী তাই করেন।
অভীক ফেরেন সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। লিফটের দরজা খুলে নেমেই ‘আঁতকে’ ওঠেন তিনি। দেখেন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। করিডর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই চোখে পড়ে রক্তে ভিজে যাওয়া শরীরে লিভিং রুমের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে রয়েছেন পল্লবী। তাঁকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করেন অভীক। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। উন্মাদের মতো দুই প্রতিবেশীর কলিং বেল টিপতে থাকেন। তাঁরাও বেরিয়ে আসেন। খবর যায় পুলিশে। ওয়াডালা ট্রাক টার্মিনাস থানা থেকে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় পুলিশ। দেখে জোর করে দরজা ভেঙে ঢোকার কোনও চিহ্ন নেই। ঘর থেকে কোনও কিছু চুরিও যায়নি! |
মুম্বইয়ে পল্লবীর বাবা। ছবি: পিটিআই |
আইএএস দম্পতি অতনু ও সুমিতা পুরকায়স্থর মেয়ে পল্লবী। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদই মুম্বই পুলিশ কমিশনারের দফতর থেকে ফোন চলে আসে ক্রাইম ব্রাঞ্চে। তদন্তের ভার নিতে হবে তাঁদের। ক্রাইম ব্রাঞ্চের জয়েন্ট কমিশনার হিমাংশু রায়ের নেতৃত্বে তদন্ত দল তৈরি হয়। অভীক, দুই প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পরিচারিকা, ইলেকট্রিশিয়ান সবাইকে জেরা করা হয়। মোবাইলের ‘কল ডিটেলস’ এবং বিবিএম টেক্সট বের করে পুলিশ। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সে রাতে পাহারায় থাকা নিরাপত্তা রক্ষী সাজ্জাদ উধাও। দিনভর তল্লাশির পর অবশেষে মুম্বই সিএসটি রেল স্টেশনে পাওয়া যায় সাজ্জাদকে। সারা রাত জেরার পর, শেষমেশ সবই উগরে দেয় সাজ্জাদ মোগল।
ক্রাইম ব্রাঞ্চের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কথায়, সাজ্জাদের বর্ণনা অনুযায়ী ডাকাবুকো পল্লবী পোশাকআশাকেও সাহসী ছিলেন। অনেক দিন ধরে সাজ্জাদের নজর ছিল তাঁর ওপর। সে এও জানত, অভীক প্রায়শই কাজ সেরে ভোর রাতে বাড়ি ফেরেন। সে সব মাথায় রেখে ‘সুযোগের’ অপেক্ষায় ছিল সাজ্জাদ। পরশু নাইট ডিউটি ছিল তার। আর সেদিনই কাণ্ডটা ঘটাবে বলে মনে মনে স্থির করে রেখেছিল। সন্ধ্যা গড়াতেই সে-ই বেসমেন্টের মিটারবক্স থেকে পল্লবীর ফ্ল্যাটের কানেকশন অফ করে রাখে। তার পর ইলেকট্রিশিয়ান এলে তাঁর সঙ্গে পল্লবীর ফ্ল্যাটে যায়। ফ্ল্যাটের চাবি পল্লবী কোথায় রাখেন, তা তখনই দেখে নেয় সাজ্জাদ। ইলেকট্রিশিয়ান চলে যাওয়ার পর ফের মিটারবক্স থেকে কানেকশন কেটে দেয় সে। দ্বিতীয় বার ইলেকট্রিশিয়ান এলে তাঁর সঙ্গে আবার লিফটে করে পল্লবীর ফ্ল্যাটে ঢোকে সাজ্জাদ। সে বার পল্লবী ও ইলেকট্রিশিয়ান যখন ফ্রিজ, এসি বন্ধ করতে ব্যস্ত, তখন চাবির গোছা সন্তর্পণে পকেটে পুরে ফেলে সে। তার পর পৌনে দুটো নাগাদ, লিফটে চড়ে ১৬ তলায় উঠে আসে সাজ্জাদ। কোমরে গুঁজে রাখে ধারালো ছুরি। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সোজা পল্লবীর বেডরুমে ঢুকে পড়ে সাজ্জাদ। তার পর ঘুমন্ত পল্লবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। সাঁতারে জাতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন পল্লবী। তাঁর গায়ে জোর কম ছিল না। তুলনায় সাজ্জাদই বরং রোগাপাতলা। সাজ্জাদকে বাধা দিতে দিতে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকেন পল্লবী। এক হাতে সাজ্জাদের চুলের মুঠি ধরে অন্য হাত দিয়ে যথাসম্ভব বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে যান। এরপর কোমরে গুঁজে রাখা ছুরি বের করতে আর দেরি করেনি সাজ্জাদ। এলোপাথাড়ি তা চালাতে থাকে পল্লবীর শরীরের ওপর। তারপরেও সাজ্জাদের হাত ছাড়িয়ে পল্লবী দরজার দিকে চলে যান। রক্তে ভেসে যায় বেডরুম, লিভিংরুম। ধস্তাধস্তির পর কোনওক্রমে দরজার বাইরে করিডরে বেরিয়েও এসেছিলেন পল্লবী। চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মুখ চেপে ধরে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে ফের ফ্ল্যাটের মধ্যে নিয়ে আসে সাজ্জাদ। তারপর পল্লবীর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছুরি দিয়ে গলা কেটে দেয়।
পল্লবীর প্রাণপণ চিৎকার প্রতিবেশীরা নাকি কেউই শুনতে পাননি (অন্তত জেরায় তাঁরা পুলিশকে যা জানিয়েছেন)। কেউ দরজাও খোলেননি। সাজ্জাদ কিন্তু এ বার লিফটে নামেনি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে তিন তলার এক ফ্ল্যাটের বাইরে রাখা জুতোর র্যাকের তলায় খুনের অস্ত্রটি লুকিয়ে রাখে। তার পর অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচিল টপকে পালায়। কাল সারাদিন মুম্বইয়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরে সে। মতলব ছিল মুম্বই সিএসটি থেকে ট্রেন ধরে রাতে কাশ্মীর পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেয়নি পুলিশ। তারা দেখে, সাজ্জাদের শরীরে আঘাতের দাগ কম নয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন পল্লবী।
পল্লবীর দেহ ময়নাতদন্তের পর গত রাতেই দাহ করেছেন তাঁর পরিবার। তাঁর হাতের মুঠোয় আটকে থাকা চুল, রক্ত, ডি এন এ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের দফতরে আজ সাংবাদিক বৈঠক করেন যুগ্ম কমিশনার হিমাংশু রায়। সাম্প্রতিক কালে মুম্বইয়ে কোনও খুনের ঘটনার এত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তদন্ত হয়নি। তবে খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “পল্লবী মৃত। খুব সাহসী মেয়ে ছিলেন উনি। ওঁর মর্যাদার কথা মাথায় রেখে এমন কিছু প্রশ্ন করবেন না যার উত্তর দিতে অসুবিধা হয়। শুধু এ টুকু বলতে পারি ঘৃণ্য, বিকৃত মানসিকতার ছেলে সাজ্জাদ।”
তা হলে কি অভীক, ইলেকট্রিশিয়ান-সহ বাকিদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখছে পুলিশ? পড়শির কলিং বেলে রক্তের দাগ নিয়ে হাতের ছাপ কার? অভীকের না পল্লবীর? পড়শিরাই বা পল্লবীর চিৎকার শুনতে পেলেন না কেন? জবাবে হিমাংশু বলেন, “খুনের কার্যকারণ মোটামুটি স্পষ্ট। পল্লবীর রক্তাক্ত দেহ আঁকড়ে ধরে তার পর কলিং বেল টিপেছিল অভীক। সম্ভবত সেই হাতের ছাপ তাঁরই। তবু পুলিশ তো! তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই সন্দেহের ঊধ্বের্র্ রাখছি না।” কাল আদালতে পেশ করা হবে সাজ্জাদ মোগলকে। ক্রাইম ব্রাঞ্চের জয়েন্ট কমিশনারের কথায়, “৩২০ ও ৩৫৪ ধারায় সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ চাইবে এমন ঠান্ডা মাথায় নৃশংস খুনের জন্য সব থেকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হোক ওকে। সেজন্য ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে রোজ শুনানি হোক। ওর ফাঁসি চাইব আমরা।” |