স্কুল শিক্ষক সৌম্যজিৎ বসুকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার পরেও চুঁচুড়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা নিয়ে এসেছিল মাওবাদীরা। দুপুরে বসুবাড়িতে মাংস-ভাতও খেয়েছিল ওই দুই মাওবাদী।
মাওবাদীদের হাতে নিহত স্কুল শিক্ষকের দাদা অভিজিৎ বসু বুধবার এই দাবি করলেন। সৌম্যজিতের স্ত্রী স্বচ্ছতোয়া ও তাঁর বাবা অনুপম ব্রহ্মচারীকে নিয়ে পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) হৃষিকেশ মুদির সঙ্গে দেখা করার পরে অভিজিৎবাবু সাংবাদিকদের সামনে ক্ষোভের সুরে বলেন, “অপহরণের পরে আমার ভাই বেঁচে আছে কি না, তা নিয়ে দিনের পর দিন আমাদের বিভ্রান্ত করে গিয়েছেন পুলিশের একাংশ। শুনেছি ভাইয়ের কিছু জিনিসপত্র মিলেছে। তা নিয়েও কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ভাইকে অপহরণের পরে মাওবাদীরাও আমাদের চরম বিভ্রান্ত করেছে।”
২০১০ সালের অক্টোবরে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে এসে মাওবাদীদের হাতে অপহৃত হন স্কুল শিক্ষক সৌম্যজিৎ ও গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার পার্থ বিশ্বাস। জলধর সিং সর্দার নামে এক মাওবাদী স্কোয়াড সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানতে পারে, অপহরণের রাতেই অযোধ্যা পাহাড়ে পার্থ-সৌম্যজিৎকে মাওবাদীরা শ্বাসরোধ করে মেরেছিল। |
সৌম্যজিৎ বসুর স্ত্রীর হাতে চেক তুলে দিচ্ছেন জেলাশাসক।
|
তার আগে মাওবাদীরা সৌম্যজিতের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন করে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কয়েক বার কথাও
বলেছিল। আশ্বাস দিয়েছিল, তাঁর ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু তার পরেও কেন তাঁকে খুন করা হল, তার সদুত্তর মেলেনি।
অভিজিৎবাবুর কথায়, “অপহরণের পরে দুই মাওবাদী আমাদের বাড়ি এসেছিল। মা মুরগির ঝোল, ভাত রান্না করে ওদের খাইয়েছিল। টাকাও নিয়েছিল। ভাইকে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ভাই আর ফিরল কই?” অতিরিক্ত জেলাশাসক অভিজিৎবাবুদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, খুনিদের কোনও নীতি নেই। ওই সময় অযোধ্যা পাহাড় ওদের মুক্তাঞ্চল ছিল।
অভিজিৎবাবু এ দিন জানান, মাওবাদীদের যে অযোধ্যা স্কোয়াড সৌম্যজিৎকে খুন করেছিল, তার নেতা ধৃত বিক্রমের সঙ্গে কথা বলতে চান তাঁদের মা। এ দিন অতিরিক্ত জেলাশাসকের কাছে মায়ের সেই আর্জি লিখিত ভাবে জানান অভিজিৎবাবু। ঘটনাচক্রে এ দিনই পুরুলিয়া আদালতে এসিজেএম মৃত্যুঞ্জয় কর্মকারের এজলাসে বিক্রম ওরফে অর্ণব দামকে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁকে ১৪ দিন জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দেন। |
ছোট ছেলে সৌম্যজিৎ মৃত্যুর আগে কী বলেছিলেন, বিক্রমের কাছে তা জানতে চাওয়ার ইচ্ছা আগেই জানিয়েছিলেন নিহত স্কুল শিক্ষকের মা। অভিজিৎবাবু বলেন, “মাওবাদীরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। ভাইকে ছেড়ে দেবে জানিয়েছিল। তার পর কী এমন ঘটল যে ওকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিল? এডিএমের কাছে বিক্রমের সঙ্গে মায়ের দেখা করানোর অনুমতি চেয়েছি।”
সৌম্যজিতের মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন?
আদালত চত্বরে বিক্রম একান্তে আনন্দবাজারকে এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “আমি তো জঙ্গলমহলে যত রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়েছি। এখন বললে অনেক কথাই বলতে হয়। আর এই বিষয়গুলি এখন আদালতের বিচারাধীন। তাই কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।” অতিরিক্ত জেলাশাসক বলেন, “বিক্রমের সঙ্গে মায়ের দেখা করাতে চেয়ে অভিজিৎবাবু আবেদন করেছেন। এ ব্যাপারে আইনগত দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
অতিরিক্ত জেলাশাসকের সঙ্গে অভিজিৎবাবুর প্রায় মিনিট কুড়ির কথোপকথনের সময় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে একেবারেই চুপচাপ ছিলেন স্বচ্ছতোয়াদেবী। যিনি এ দিনই প্রথমবার পা রাখলেন পুরুলিয়ার মাটিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সৌম্যজিৎবাবুর পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয়। স্বচ্ছতোয়াদেবীর হাতে ওই চেক তুলে দেওয়ার সময় পুরুলিয়ার জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ তাঁর কাছে চার বছরের ছেলে রোদ্দুরেরও খবর জানতে চান। |