স্কুলের ‘পুলকার’-এ যাতায়াত করত বেহালার বছর দশেকের মেয়েটি। ফেরার সময়ে অন্য ছাত্রীরা নেমে যাওয়ার পরে কিছুটা রাস্তা একাই যেতে হত তাকে। ‘ড্রাইভারকাকু’ ওই সময়ে ছাত্রীটিকে ডেকে নিত তার পাশের আসনটিতে। আর সেখান থেকে শুরু ‘অসভ্যতা’-র। লজ্জা, ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেনি শিশুটি। অনেক পরে মেয়েটি তার মাকে ঘটনাটি বললে বিষয়টি জানাজানি হয়।
বেহালার ওই শিশুটির মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে সোমবার সোদপুরের দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীরও। এলাকার বাসিন্দারাই স্কুলগাড়ির চালককে ওই অবস্থায় দেখে পুলিশের হাতে তুলে দেন। রাতে ওই ছাত্রীর বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় স্কুলগাড়ির চালককে। মঙ্গলবার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে ওই চালক।
এ কারণেই অভিভাবকদের একাংশ, যাঁদের সুযোগ রয়েছে, নিজেদের গাড়িতেই শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। বিকল্প খুঁজছেন আরও অনেকে। এতে মার খাচ্ছে স্কুলগাড়ির-ব্যবসাও। ‘পুলকার ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ তাই এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। সংগঠনের সম্পাদক আবির রায় বলেন, ‘‘আমাদের সংগঠন এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে স্কুলগাড়িতে মহিলাকর্মী রাখা শুরু করেছে। সব স্কুলগাড়িতেই যাতে মহিলাকর্মী রাখা হয়, সে জন্য রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীর কাছেও একটি দাবিপত্র দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করলেই সব স্কুলগাড়ির মালিক তা মানতে বাধ্য হবেন।”
এ ঘটনা ঘিরে অস্বস্তিতে সরকারও। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “স্কুলগাড়িতে এক জন মহিলাকর্মী থাকলে তিনি ওই শিশুদের দেখভাল করতে পারবেন। বুধবার আমি পুলকার সংগঠনগুলিকে আলোচনায় ডেকেছি। সেখানে এই প্রসঙ্গটি তুলব।”
বেহালা বা সোদপুরে এ ধরনের শিশু-নিগ্রহকে এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন না সমাজতত্ত্ববিদেরা। সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র বলেন, “আগে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য বা জীবন চালানোর জন্য নিকটাত্মীয়ের উপরে ভরসা করতেন। কিন্তু এখন মানুষকে জীবন চালাতে অপরিচিতদের উপরে ভরসা করতে হয়। যে কোনও সভ্য সমাজ এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে এত মানুষ ভরসা করে তাঁদের শিশুকে স্কুলগাড়ির ড্রাইভার-খালাসির হাতে তুলে দিচ্ছেন। সেখানে এই রকম মারাত্মক বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা সমাজ।”
তবে পুলিশকর্তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের ঘটনার কথা জানার পরেও বেশির ভাগ অভিভাবকেরাই শিশুদের কথা ভেবে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে চান না। সাধারণত স্কুলগাড়ি ছাড়িয়ে বিকল্প কোনও ব্যবস্থার খোঁজ করেন তাঁরা। পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, এতে লাভ হয় অপরাধীদেরই। তারা ফের নতুন ‘শিকার’ খুঁজতে শুরু করে। সোদপুরের ঘটনাটির পরে বেলঘরিয়ার অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটলেও আমরা জানতে পারি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা অভিযোগ করেন না। এগুলির প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করেন। তবে আমরা বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’’
এ রকম অভিজ্ঞতা হলে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে শিশুদের? মনোবিদ প্রশান্তকুমার দে বলেন, “কোনও শিশু ছোটবেলায় যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হলে সারা জীবন মনে তার প্রভাব থাকতে পারে। সে আতঙ্কে ভুগতে পারে, নানা রকমের মানসিক সমস্যা হতে পারে, পুরুষের প্রতি চিরস্থায়ী ঘৃণা বা অবিশ্বাস জন্মাতে পারে। অনেকে এর ফলে আর কোনও দিন স্বাভাবিক সংসার জীবনে ঢুকতেই পারে না।” |